উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে মুজফ্ফরনগর জেলায় দাঙ্গার আগুন প্রশমিত হওয়া দূরস্থান, গত শনিবার শুরু হওয়া হানাহানি সংলগ্ন শামলি ও বাগপত জেলাতেও ছড়াইয়া পড়িয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের সরকার অনেক বিলম্বে নড়িয়া বসিয়াছে। শুধু তাহাই নহে, গোয়েন্দা রিপোর্টে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সতর্কবার্তা থাকিলেও তাহাতে যথাসময়ে গুরুত্ব দেয় নাই। এমন অভিযোগ কেবল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নয়, রাজ্যপালের প্রেরিত রিপোর্টেও। প্রশাসনকে যে প্রথমাবধি দাঙ্গা মোকাবিলায় তত তত্পর দেখা যায় নাই, ইহা প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগীদেরও অভিজ্ঞতা। অনেক পর্যবেক্ষকেরই মনে হইয়াছে, অখিলেশ সরকার যেন কিছুটা সীমিত হানাহানি ও রক্তপাত শুরুতে ঘটিতে দিয়া দম-চাপা উত্তেজনার জমাট বাষ্প বাহির করিয়া দিতে চাহিয়াছে। স্বভাবতই রাজনৈতিক দলগুলি রাজ্য সরকারের সমালোচনায় মুখর।
সমালোচনা অমূলক নয়। পরিসংখ্যান বলিতেছে, সমাজবাদী পার্টি রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার আগের পাঁচ বছরে উত্তরপ্রদেশে একটিও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে নাই। কৃতিত্বটি অবশ্যই মায়াবতী সরকারের। তুলনায় মুলায়ম সিংহ যাদবের সমাজবাদী পার্টি ক্ষমতাসীন হওয়া ইস্তক রাজ্যের নানা স্থানে হিংসা, হানাহানি, রক্তপাতের ছড়াছড়ি। এক বছরেই এমন ৫০টি ঘটনা তালিকাভুক্ত। সব কয়টি যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাপ্রসূত, এমন নয়। কিন্তু দুর্বৃত্তরা যে বর্তমান জমানায় রাজ্যের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হইয়া উঠিতেছে, এই দুর্লক্ষণ সর্বত্র। প্রায় সকলের হাতেই বন্দুক। রাজনীতিক নেতার আশ্রিত হইলে এমনকী রাজ্য পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার আধিকারিককেও হত্যা করিয়া পার পাওয়া যায়। স্বভাবতই পুলিশ শঙ্কিত, সন্ত্রস্ত, দুষ্টের দমনে দ্বিধাগ্রস্ত, এমনকী নিশ্চেষ্ট। তাই যখন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াইতেছে কিংবা দাঙ্গার আগুনে বস্তি-মহল্লা জ্বলিতেছে, তখনও পুলিশ দর্শক। আধিকারিকরাও যে আইনের শাসন বলবত্ করিতে গিয়া রাজনীতিকদের বিরাগভাজন হইয়া সাসপেন্ড হইতেছেন, আইএএস অফিসার দুর্গাশক্তি তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ। এই অবস্থায় প্রশাসন যে কিছুটা নিশ্চেষ্ট থাকিবে, ইহা অস্বাভাবিক নয়।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য দাঙ্গার মধ্যে চক্রান্তের গন্ধ পাইয়াছেন। ইহা স্পষ্টতই নিজের অকর্মণ্যতার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপাইবার চেষ্টা। নজর ঘুরাইবার চেষ্টাও বটে। এই দাঙ্গার মধ্যে লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম ভোটের মেরুকরণ এবং সেই সূত্রে বিজেপি ও সমাজবাদী পার্টির লাভবান হওয়ার তত্ত্বও প্রচারিত হইতেছে। এ ধরনের তত্ত্ব, এমনকী সত্য হইলেও, প্রশাসনিক ব্যর্থতার অজুহাত হইতে পারে না। কিন্তু তাহার সত্যতা লইয়াও বড় প্রশ্ন আছে। যে অঞ্চলে দাঙ্গা হইতেছে, তাহা জাঠ কৃষক অধ্যুষিত। জাঠরা অধিকাংশই ধনী ও মধ্য কৃষক এবং মুসলিমরা কৃষিশ্রমিক বা ক্ষেতমজুর ও দরিদ্র চাষি হইলেও এই দুই সম্প্রদায় ঐতিহ্যগতভাবে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের মধ্যে বসবাস করেন। দাঙ্গায় তাঁহাদের কাহারও লাভ নাই। তবু দাঙ্গা ঘটিয়া যায়, প্রায়শ অকারণ গুজব, শিথিল প্রশাসন ও উদাসীন বা পক্ষপাতী পুলিশ-প্রশাসন তাহার অনুঘটক হইয়া ওঠে। রাজ্য সরকারের কর্তব্য, কঠোর হাতে সম্প্রদায়নির্বিশেষে দুষ্কৃতীদের দমন করা, যাবতীয় বেআইনি অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা এবং দুর্গতদের আশ্রয়, নিরাপত্তা ও ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা করা। ক্ষমতাসীন দল বা তাহার নেতারা যদি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরিতে তত্পর হইয়া ওঠেন, তাহার পরিণাম ভয়ংকর হইতে বাধ্য। বিংশ শতাব্দীর ভারত তথা তাহার সর্বাপেক্ষা জনবহুল রাজ্যটি সেই পরিণাম বহু বার দেখিয়াছে। তাহাকে ইতিহাসের পাতায় স্থান দেওয়াই কাম্য। সব ইতিহাস সঙ্গে লইয়া চলিতে নাই। |