|
|
|
|
আমেরিকায় বসে আজও খুনের হুমকি পাই |
মিস আর্থ প্রতিযোগিতায় লাল বিকিনি পরার বিতর্কের পর আর প্রবেশ করতে পারেননি আফগানিস্তানে।
বাঙালি লেখিকা সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর হত্যার পর ভিদা সামাদজাই লস এঞ্জেলেস
থেকে ফোনে নিজের অভিজ্ঞতা শোনালেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত-কে |
বাঙালি লেখিকা সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুন হওয়ার খবরটা শুনেছেন? হ্যাঁ, শুনেছি। ইনফ্যাক্ট, এক ঝলক বিবিসি-তে দেখলাম।
ওঁর সম্বন্ধে জানতেন আপনি? ওঁর সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ ছিল না। শুধু এটুকু জানি ওঁর লেখা বই থেকে সিনেমা হয়েছে একটা। মনীষা কৈরালা অভিনয় করেছিলেন। এর বেশি আর কিছু জানি না।
ওঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল? অবশ্যই এটা খুব দুঃখের। একজন মানুষের মারা যাওয়া গভীর বেদনা বয়ে আনে। ওঁর পরিবার আর বন্ধুদের সঙ্গে আমি সমব্যথী। আসলে মৃত্যুকে মেনে নেওয়া সব সময়ই কঠিন।
খবরটা নিশ্চয়ই আফগানিস্তানে আপনার নিজের সংগ্রামের স্মৃতিকে উস্কে দিয়েছে? অবশ্যই। খবরটা অনেক স্মৃতি উস্কে দিয়েছে। আমার নিজের সংগ্রাম তো আছেই। মালালা ইউসুফজাই-য়ের কথাও মনে পড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানে ও-ও তো নারীর অধিকার আর শিক্ষার এক প্রতীক। মনে পড়ে গেল কী ভাবে মালালাকে স্কুলে যাওয়ার পথে গুলি করা হয়। পরীক্ষা শেষে স্কুল থেকে বাসে বাড়ি যাচ্ছিল ও। এমন অনেক ঘটনা আমার মাথায় ভিড় করে আসে। মহিলাদের ন্যূনতম অধিকার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আরও ডাক্তারখানা বানাতে হবে।
আপনি কি আফগানিস্তানে থাকার সময় প্রাণনাশের হুমকি পেতেন? আমার দেশের অনেকেই সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় আমার অংশগ্রহণ করাকে ভাল চোখে দেখেননি। হ্যাঁ, এখনও আমি খুনের হুমকি পাই। কিন্তু সে সবে আর পাত্তা দিই না। |
|
ভিদা সামাদজাই |
আর তা ছাড়াও তো ছিল আপনার সেই লাল বিকিনি বিতর্ক! আফগানিস্তানের সুপ্রিম কোর্টও তো আপনার মিস আর্থ-য়ে অংশগ্রহণ করাকে ভর্ৎসনা করেছে। বলা হয়েছিল নারী শরীরের প্রদর্শন ইসলামি আইন আর আফগানি সংস্কৃতির বিরোধী... দেখুন, আমি তো বিতর্ক করার জন্য বিকিনি পরিনি। এমনকী এটাও ভাবিনি যে বিকিনি পরলেই আমি বিউটি কনটেস্টে জিততে পারব।
তা হলে কী কারণ ছিল? আমি লাল বিকিনি পরেছিলাম কারণ, আমার ধমনীতে আজও স্বাধীনচেতা আফগানি মহিলাদের রক্ত বইছে। দেখুন, আমি তো মহিলা হিসেবে সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলনে নামিনি। আমি শুধু মহিলাদের ন্যূনতম অধিকারের কথা বলেছি। আমি সেটাই সব সময় চেয়ে এসেছি। আমি শুধু ওদের বোঝাতে চেয়েছি, কোনও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে আমি এটা করছি না। পশুরাও তো ন্যূনতম স্বাধীনতা উপভোগ করে। মহিলারা তা চাইলেই কেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে?
রক্ষণশীল পরিবেশে বন্ধনহীন কোনও নারীর পোশাক পরা নিয়ে কী বলবেন? এটা নির্ভর করে সংস্কৃতি আর ধর্মের ওপর। ওগুলোকে কখনও অসম্মান করা উচিত নয়। যদি কোনও মসজিদে যান, আপনাকে মাথা ঢাকতেই হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে হবে, নিজের জায়গায় একজন নারীর পোশাক পরার স্বাধীনতা থাকতেই হবে।
মৃত্যুভয়কে সামলান কেমন করে?
আমার ও ভয় নেই। ঈশ্বরই জন্ম-মৃত্যু ঠিক করে দেন। ‘নসিব’য়ে যা থাকবে, তা তো কেউ পালটাতে পারবে না। কিন্তু সেটা ভেবে প্রতি মুহূর্তে বাঁচব না কেন?
সহজেই কি আপনার চোখে জল চলে আসে? সেটা নির্ভর করে আপনি কত গভীর ভাবে আহত হয়েছেন, তার ওপর। কাবুলে আমার প্রতিবেশীদের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। ওঁরা থাকতেন একটা বাড়ির পাঁচ তলায়। এক আদিবাসী গোষ্ঠীর কয়েক জন তাঁদের বাড়িতে এসে বলেছিল, তাঁর মেয়েকে দিয়ে দিতে। তিনি সেই দলকে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে বললেন। মেয়েকে স্নান করে নমাজ পড়তে বললেন। আর তারপর নিজের মেয়েকে হত্যা করলেন। আমরা মেয়েটার চিৎকার শুনতে পেয়েছি। কিন্তু একজন পিতার কাছে আদিবাসী গোষ্ঠীর হাতে মেয়ে দেওয়ার থেকে তাকে হত্যা করা অনেক সম্মানের।
আফগানিস্তানে আপনার শৈশব কেটেছে। কৈশোরেও দেখেছেন আফগানিস্তানকে। এই দুই সময়ের মধ্যে কোনও তফাত লক্ষ করেছেন? হ্যাঁ, তফাত তো আছেই। ছোটবেলায় বাড়ির মহিলাদের যে সব ছবি দেখতাম তাতে পরিষ্কার বোঝা যেত কতটা স্বাধীনতা ওঁরা উপভোগ করতেন। মাই আন্ট ওয়াজ আ ল’ইয়ার। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেছিলেন। আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন আফগানিস্তানের রাজার খুব কাছের লোক। আমার কাকারা আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত ছিলেন। আমার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। পুরুষ হোন কী মহিলা। আমি কাবুলের রাস্তায় মহিলাদের গাড়ি চালানোর ছবি পর্যন্ত দেখেছি।
সে সময়টা কখন? আমার মনে হয় সেটা সত্তরের দশক। মায়ের কাছে শুনেছি, সেই সময় কাবুলকে বলা হত দ্বিতীয় প্যারিস। ভোগ ম্যাগাজিন থেকে অনুপ্রাণিত হতেন আফগানি মহিলারা। আমার তখনও জন্ম হয়নি। কিন্তু আমি গল্প শুনেছি। আমার জন্ম হয় সত্তরের দশকের শেষের দিকে। আমার বাবা আমাদের কাবুল শহরের একটা অংশে নিয়ে যেতেন, যাকে বলা হত নতুন শহর‘শহর-এ-নাউ’। সেখানে অনেক সুন্দর জায়গা ছিল। ওখানে রেস্তোরাঁয় পুরুষেরা তাঁদের বান্ধবীদের নিয়ে যেতে পারতেন। কেউই মহিলাদের অন্য চোখে দেখতেন না। আফগান পুরুষেরা নিজেদের দেশ এবং মাকে সমান সম্মান করতেন। মহিলাদের অসম্মান করার কোনও প্রশ্নই ছিল না।
তার মানে আপনিও স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছেন? হ্যাঁ, তা তো করেছিই। আমি তখনও খুবই ছোট। শুনতাম মহিলা ডাক্তারেরা পার্লামেন্টে যোগ দিচ্ছেন। অনেক মহিলা আইনজীবী ছিলেন। মহিলা উপস্থাপকেরা নিজের খুশিমতো পোশাক পরতে পারতেন। আমরা, ছোটরা, যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারতাম। আমি তো ছোটবেলায় এক টিভি অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলাম।
কবে এ সব বদলে গেল? তখন আমি কৈশোরে পড়েছি। হঠাৎ- হঠাৎ রকেটের আওয়াজ শুনতে পেতাম। প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে হত বেসমেন্টে। সব শান্ত হওয়ার পর শুনতাম, আমাদের কোনও এক প্রতিবেশী নিহত হয়েছেন রকেটের আঘাতে। প্রতিটা মোড়েই যেন মৃত্যু ওঁত পেতে রয়েছে।
তা তালিবান রাজত্বের পর আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কতটা বদলেছে? অনেকটাই বদলেছে। আমি কয়েক জন মহিলাকে জানি যাঁরা টিভিতে গান করেন। অলিম্পিকেও গিয়েছেন আরও কেউ। এখন অনেক মহিলাই পড়াশোনা করছেন। অনেকেই স্বাধীন। কেউ কেউ ছোটখাটো ব্যবসাও করছেন।
আফগান মহিলারা তো এখন খেলাধুলাতেও অংশ নিচ্ছেন। সিনেমা করছেন। তবু তাঁদের উন্নতির অনেক বিপরীতমুখী গল্প শোনা যায়... হ্যাঁ, সেটা ঠিক। আমি আগের বছর অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করা আফগান মহিলাদের সঙ্গে কথা বলেছি।
মেহবুবা বলে একজন ছিলেন। একটি স্টেডিয়াম, যেখানে প্রাণদণ্ড দেওয়া হত, সেখানে উনি প্র্যাকটিস করছিলেন বলে ওঁকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া হয়েছিল...
হ্যাঁ, স্টেডিয়ামে এ রকম একটা ব্যাপার ঘটেছিল। আগের বছর অলিম্পিকের সময় আমি লন্ডন গিয়েছিলাম। আমি, তহমিনা কোহিস্থানির সঙ্গে দেখা করেছিলাম। একশো মিটার দৌড়ে ও আফগানিস্তানের প্রতিযোগী ছিল। আমি জানি যে এটা ওর জন্য মোটেও সহজ কাজ নয়। ওর বাবা-মা যে খুব খুশি ছিলেন, তা নয়। তবে আফগানিস্তানের রাজধানী এখনও অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক বেশি সুরক্ষিত। কেন না সেখানে আফগান মিলিটারি ফোর্স রয়েছে। কিন্তু তার বাইরে মেয়েদের সুরক্ষার ব্যাপারটা একেবারেই অন্য রকম। আফগানিস্তানে মেয়েদের জন্য দু’টো আলাদা বাস্তব রয়েছে।
শেষবার দেশে কবে গিয়েছেন? সেই ১৯৯৪ সালে।
দেশের মাটি, বাতাস নিশ্চয়ই খুব মিস করেন? হ্যাঁ, করি। এখনও দেশের কোথাও কোথাও আমার কিছু আত্মীয় রয়েছেন।
তাঁরা কি আপনার সঙ্গে আত্মীয়তার জন্য প্রতিকূলতার সম্মূখীন হন? কখনও কখনও, সাংস্কৃতিক বা সামাজিক দিক দিয়ে, তাঁদের হয়তো নানা ধরনের কথা শুনতে হয়। তবে বেশির ভাগই আমাকে নিয়ে খুব গর্বিত। |
|
আপনার কি মনে হয় না যে সুস্মিতার এটা বোঝা উচিত ছিল যে দেশ থেকে তিনি একবার পালিয়ে এসেছেন, সেই দেশে আবার ফেরত যাওয়াটা তাঁর পক্ষে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে? আমি আমার দেশকে মিস করি। যদি শুধুমাত্র আবেগ দিয়ে ভাবতাম তা হলে অনেক দিন আগেই আবার কাবুল যেতাম। আমি জানি ওখানে গিয়ে আমি অন্তত কয়েক মাস তো থাকতেই পারব। কিন্তু ইমোশনটাই সব নয়। সতর্ক থাকাটাও উচিত। আমি সুস্মিতার ব্যাপারে পড়েছি। ওঁর মধ্যে হয়তো সেই প্যাশনটা ছিল বা হয়তো উনি পরিবারকে খুব মিস করছিলেন। আসলে ওঁর মধ্যে ওখানকার মহিলাদের সাহায্য করার একটা তীব্র ইচ্ছা জন্মেছিল। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লেখিকা হিসেবে নিজের কেরিয়ারটাকে নতুন করে গড়তেও চেয়েছিলেন। আমার মনে হয় উনি নিজের বইটার একটা সিক্যুয়েল লিখতে চেয়েছিলেন। ওখানে ফেরত যাওয়ার জন্য ওঁকে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করতে হয়েছিল। কিন্তু এটাও বলব সব জিনিসের একটা সঠিক সময় রয়েছে। কখন কোন কাজটা করা দরকার সেটার একটা হিসেব রাখা দরকার, আর তার সঙ্গে সতর্ক থাকাটাও খুব প্রয়োজন। দিন তিনেক আগে আমেরিকার গৃহহীনদের জন্য ফান্ড গঠনের একটি কাজে আমি যুক্ত ছিলাম। কাজটা করতে করতে প্রতিটা মুহূর্তে আমি নিজের দেশের গৃহহীন মানুষগুলোর কথা ভাবছিলাম। তা সত্ত্বেও আমি দেশে ফিরে যাওয়ার পদক্ষেপটা নিইনি।
সামনে আর কী প্ল্যান রয়েছে? ভারতে কবে আসছেন? আমি এখনও পৃথিবীর জন্য অনেক কিছু করার চেষ্টায় আছি। আমি শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। রাষ্ট্রসঙ্ঘের হয়ে কাজ করতে পারাটাও আমার লক্ষ্য বলতে পারেন। গ্রিসের অলিম্পিক কমিটির কর্তাদের তরফ থেকে ‘টর্চ বার্নিং সেরিমনি’তে যাওয়ারও আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আমি রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর মিটিংয়ে উপস্থিত থাকি। তা ছাড়াও ফান্ড গঠনের নানা অনুষ্ঠানেও যাই। চ্যানেল ভেরিসা-র বেশ কিছু শো-য়ের জন্যও কাজ করছি। আপাতত, ইউএসএ-তে হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিতে দু’টো ব্যবসা আছে আমার। ভারতে এ বছরের শেষে আসতে চাই।
সিনেমায় নিজের কেরিয়ার নিয়ে কী ভাবছেন? ভারতীয় সিনেমা দেখেন? যতটা উদ্দীপনার সঙ্গে নিজের সিনেমার কেরিয়ারটা শুরু করা উচিত ছিল ততটা আমি করিনি। তবে ভারতীয় সিনেমা দেখি। ‘জঞ্জির’ বলে যে নতুন সিনেমাটা হচ্ছে সেটার গান শুনেছি। পরিচালক অপূর্ব লাখিয়া আমার বন্ধু। কয়েক দিন আগেই ‘থ্রি ইডিয়টস’ দেখেছি। আর হ্যাঁ, ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ও দেখলাম। দীপিকা আর আমি এক সময়ে র্যম্পে একসঙ্গে হেঁটেছি। তাই এখন ওকে সিনেমায় দেখতে খুব ভাল লাগে। আর একজনের কথা না বললেই নয়। সে আমার পাঠান খান। এসআরকে। |
|
|
|
|
|