একটি বিশেষ ইঞ্জেকশন, সংখ্যায় দু’ হাজারটি থাকলেই হাসপাতালের প্রয়োজন মেটে। অথচ কেনা হয়েছে তার প্রায় ১২ গুন বেশি। অন্য একটি ওষুধ, যার একটিও এই মুহূর্তে ওই হাসপাতালের জন্য কেনা দরকার ছিল না। কিন্তু হাসপাতালকে দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার। একটি বা দু’টিই নয়, একাধিক ওষুধের ক্ষেত্রে একই কাণ্ড ঘটেছে। এ দিকে আবার ওই বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত ওষুধের বেশির ভাগই মেয়াদ পেরনোর মুখে বলে অভিযোগ উঠেছে!
সম্প্রতি সিউড়ি সদর হাসপাতালে জননী সুরক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পে পাঠানো ওষুধের ক্ষেত্রে এমন চিত্রই উঠে এসেছে। যার জেরে জেলা স্বাস্থ্য দফতরের রিজার্ভ স্টোরে ওষুধ কেনা নিয়ে ঘোরতর অনিয়মের অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। শুধু সিউড়িই নয়, জেলার নানা হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অতিরিক্ত পরিমাণ ওষুধ কিনে সরবরাহ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি। এ ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ টাকার দুর্নীতির আশঙ্কাও তাঁরা করছেন। এই অবস্থায় ইতিমধ্যেই বাড়তি ওষুধ ফেরত নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন সিউড়ি সদর হাসপাতালের সুপার অসিত বিশ্বাস। পরপর দু’টি ডেলিভারির ক্ষেত্রে এমন ঘটতে দেখে গত জুলাই ও অগস্টে দু’বার তিনি জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছেন।
সিউড়ি সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ক্ষেত্রে সচরাচর বছরে দেড়শো জন রোগীর খিঁচুনি রোগ দেখা যায়। ওই অসুখে বড় জোর ৬ হাজার ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ইঞ্জেকশন লাগে। কিন্তু জেলা রিজার্ভ স্টোর থেকে গত ৩ জুলাই ওই হাসপাতালে ওই ইঞ্জেকশন পাঠানোর পরিমান ২৫ হাজার। একই ভাবে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ৪০ হাজার ল্যাবটেলল ট্যাবলেট পাঠানো হয়েছে। যেখানে বছরে ৫ হাজারেই হাসপাতালের প্রয়োজন মিটে যায়। হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, “অতিরিক্ত ওষুধ রেখেই দেওয়া যায়। পরে বিভিন্ন সময়ে সেগুলি কাজে লাগানো যেত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ওই ওষুধগুলির অধিকাংশেরই মেয়াদ ফুরনোর তারিখ এত কাছে যে সেগুলি রেখে দেওয়ার ঝুঁকি আমাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়।” তাই ওষুধ ফেরত নিতে আবেদন জানিয়েছিলেন হাসপাতাল সুপার।
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কার্তিক মণ্ডলের দাবি, তিনি এ নিয়ে সিউড়ি সদর হাসপাতালের সুপারের কোনও চিঠি পাননি। যদিও আনন্দবাজারের হাতে আসা চিঠি দু’টি (১৫ জুলাই পাঠানো প্রথমটির নম্বর ২৭৬৭ এবং ফের ২১ অগস্ট পাঠানো দ্বিতীয়টির নম্বর ৩২৯২) কিন্তু অন্য কথা বলছে। সুপারের থেকে চিঠি পাননি বলে দাবি করেছেন ওই ওষুধের বণ্টনের দায়িত্বে থাকা জেলার ডেপুটি সিএমওএইচ ১ গুরুদাস পাত্রও। তাঁর বক্তব্য, “সুপারের কাছ থেকে কোনও আবেদন পাইনি। পেলে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরকে জানাব।”
জেলা স্বাস্থ্য দফতরেরই একটি সূত্রের দাবি, সম্প্রতি লাইজল ও ফিনাইল কেনার ক্ষেত্রেও বড় রকমের দুর্নীতি হয়েছে। গত ২০১১-১২ আর্থিক বর্ষে রিজার্ভ স্টোরের জন্য মোট ৮৫০ বোতল লাইজল কেনা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান আর্থিক বর্ষে শুধু মে মাসেই ১১০০ বোতল লাইজল কেনা হয়েছে। কিন্তু যে দিন তা কিনতে বরাত দেওয়া হয়, ঠিক তার পরের দিনই বোতল পিছু ৩১১ টাকা করে দাম কমে যায়। অভিযোগ, দাম কমে যাওয়ার খবর আগে থেকে জানা ছিল বলেই আগের দিন অত বড় বরাত দেওয়া হয়। যার জেরে লাভবান হয় সংশ্লিষ্ট ওষুধ বিক্রেতা সংস্থা। ওই বরাতের জন্য স্বাস্থ্য দফতরকে প্রায় ৩ লক্ষ টাকা বেশি দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ। একই ভাবে ফিনাইল কিনতেও প্রায় ৬ লক্ষ টাকা বেশি খরচ করা হয়।
গত বুধবারই এ নিয়ে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে একটি স্মারকলিপি দিয়েছে বীরভূম জেলা ফার্মাসিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের অভিযোগ, স্টোরে ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে ফার্মাসিস্টদের বক্তব্যই শোনা হচ্ছে না। ওষুধ সম্বন্ধে ন্যূনতম জ্ঞান নেই, এমন সব লোকেরাই অতিরিক্ত ওষুধ কেনানোর জালিয়াতিতে লিপ্ত হয়েছেন। সংগঠনের জেলা সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র চন্দ্রের দাবি, “একদিকে জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমানে জীবনদায়ী ওষুধ মিলছে না। অন্য দিকে, কয়েকটি ওষুধ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনা হচ্ছে। আমাদের আশঙ্কা ওই সব ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে বড় রকমের দুর্নীতি হয়েছে।”
ওই স্মারকলিপির পরে কার্তিকবাবুও এ নিয়ে বিশদে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। অন্য দিকে, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি তন্ময় মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমি বিষয়টি শুনিনি। তবে আগামী ১০ সেপ্টেম্বর বীরভূমে আমাদের বৈঠক আছে। সেখানেই সব জানতে পারব। কোনও গোলমাল হয়ে থাকলে তা ধড়া পড়বে।” |