ফের জোট-বার্তা মনমোহনের মুখে
বিচ্ছেদের এক বছর প্রায় পূর্ণ হয়ে এল। এখনও তিক্ততার রেশ পুরোপুরি কাটেনি। সদ্য শেষ হওয়া সংসদ অধিবেশনে যে দলটি কংগ্রেস তথা ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে সব থেকে বেশি সরব হয়েছে, তার নাম তৃণমূল। তবু আজ জি-২০ বৈঠক সেরে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ফেরার পথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফের জোট গঠনের সম্ভাবনা খারিজ করে দিলেন না প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
বিমানের সাংবাদিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়, লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস কি ফের মমতার সঙ্গে জোট গড়তে চাইবে? প্রধানমন্ত্রীর জবাব, “রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র বলে কিছু হয় না। তাই আমি জোটের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছি না।” এখানেই থামেননি প্রধানমন্ত্রী। বরং এক ধাপ এগিয়ে তৃণমূল নেত্রীর প্রশংসা করে বলেন, “এক সময় কংগ্রেসে মর্যাদাপূর্ণ জায়গায় ছিলেন মমতা। তৃণমূলের নেত্রী হিসেবেও তাঁকে সরকারে পেয়ে আমরা খুবই খুশি ছিলাম।” এর পরেই তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার উপরে জোর দিয়ে বলেন, “আমরা খুব বেশি করে চাইব, সম-মনোভাবাপন্ন, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি একসঙ্গে কাজ করুক। যাতে দেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক বাতাবরণ জোরদার হয়।”
প্রধানমন্ত্রীর এই বার্তায় দু’টি দিক দেখতে পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, মমতাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, চাইলে তিনি ফের কংগ্রেসের হাত ধরতে পারেন। কারণ দলের শীর্ষ নেতৃত্বই এ ব্যাপারে আগ্রহী। আর দ্বিতীয়ত, মমতা যাতে বিজেপির দিকে না যান, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির একজোট হওয়ার কথা বলে প্রকারান্তরে সেটাও মনে করিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রীর বার্তা নিয়ে মমতা বা তাঁর দল কী ভাবছে? তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব জানিয়েছেন, তাঁরা এখনই এই বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তৃণমূলের এই শীর্ষ নেতাদের এই কথার মধ্যে আবার অন্য ইঙ্গিত পাচ্ছেন দলেরই অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ‘এখনই’ গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন শীর্ষ নেতারা। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে কী হবে, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? তখন তো পরিস্থিতি বদলেও যেতে পারে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীও যখন বলেছেন, রাজনীতিতে এক সপ্তাহ অনেক সময়! আর লোকসভা ভোটের তো এখনও অনেক বাকি।
প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য, কংগ্রেস এক এক বার এক এক কথা বলে! কিন্তু তৃণমূল দায়িত্বশীল দল। তারা একটা অবস্থান নিয়ে চলে। তা ছাড়া, পঞ্চায়েতে একা লড়ে ভাল ফল করেছে দল। তাই এখনই প্রধানমন্ত্রীর কথায় আলোড়িত হয়ে জোট নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করার কোনও কারণ নেই। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের পাশে আমরা একাই ভাল আছি।” তৃণমূলের তরফে বলা হচ্ছে, কংগ্রেস নেতৃত্ব যে মাঝেমধ্যেই বামেদের সঙ্গে জোটের সম্ভাবনা উস্কে দেন, সেটাকে মোটেই ভাল চোখে দেখছেন না দলের নেতারা। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্যেই তার ইঙ্গিত রয়েছে।
তৃণমূলেরই অন্য একটি অংশ আবার বলছে, এটা দলের শেষ কথা নয়। শীর্ষ নেতৃত্ব মনমোহনের কথা পুরোপুরি উড়িয়ে তো দেননি। বরং শীর্ষ নেতৃত্ব যা বলেছেন, তাতে পরে এই নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে।
কিন্তু কেন কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের কথা ভাববেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব? দলের এই অংশের ব্যাখ্যা, শীর্ষ নেতারাও জানেন, পঞ্চায়েত ভোট আর লোকসভা ভোট এক নয়। তাই পঞ্চায়েতে ভাল ফল করার অর্থ এই নয় যে, লোকসভা নির্বাচনেও সেই ফল ধরে রাখা যাবে। উল্টে বাম বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করলে সেই আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে। তাই সে ক্ষেত্রে ‘একলা চলো’ নীতি নিলে লাভ হতে পারে বামেদেরই।
এই একই কারণে জোট নিয়ে আগ্রহ রয়েছে তৃণমূলের অধিকাংশ সাংসদেরই। তাঁরা প্রকাশ্যে সে কথা না বললেও তলে তলে বুঝতে পারছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না করার অর্থ নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করা হবে। জোট না হলে কংগ্রেসের হয়তো ক্ষতি হবে, কিন্তু তৃণমূলের নিজেরও বিশেষ লাভ হবে না। বিশেষ করে সাম্প্রতিক কয়েকটি জনমত সমীক্ষায় যখন দেখা গিয়েছে, জোট না হলে ভোটের হার কমবে তৃণমূলের, তখন ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কী?
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ
রাজনীতিতে চির শত্রু বা চির বন্ধু বলে কিছু হয় না। তাই আমি জোটের
সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছি না। এক সময় কংগ্রেসে মর্যাদাপূর্ণ জায়গায় ছিলেন
মমতা। তৃণমূলের নেত্রী হিসেবেও তাঁকে সরকারে পেয়ে আমরা খুশি ছিলাম।


কিন্তু রাজ্য কংগ্রেস কী ভাবে নেবে বিষয়টিকে?
দীর্ঘ দিন ধরেই রাজ্য নেতৃত্বের অভিযোগ, জোটের বিষয়টি দিল্লি থেকে তাঁদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়। গত লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটের আগে আসন বণ্টনের সময় অধীর চৌধুরী, দীপা দাশমুন্সিরা বারবার বলেছিলেন, চাপ দিয়ে মমতা বেশি আসন আদায় করে নিচ্ছেন। এ বারে প্রধানমন্ত্রী যে ভাবে সরাসরি জানালেন জোটের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছি না, তাতে এই দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-সহ রাজ্য কংগ্রেসের অন্য নেতারা কতটা খুশি হবেন, তাতে সন্দেহ রয়েছে। রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বের একটি সূত্র জানাচ্ছে, তাঁরা কোনও ভাবেই চান না ফের তৃণমূলের সঙ্গে জোট হোক। তাঁদের বক্তব্য, সে ক্ষেত্রে আবারও কংগ্রেসকে ভাল আসন ছাড়তে হতে পারে। তা ছাড়া তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে কংগ্রেসের অন্দরে। আসন বাড়িয়ে নেওয়ার পরে তিনি উল্টো সুরও গাইতে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে রাজ্য নেতাদের অনেকেরই।
রাজ্য কংগ্রেসের আপত্তি সত্ত্বেও দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশ এবং রাজনীতির বিশ্লেষকরা প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে খুব একটা ভুল দেখছেন না। তাঁদের মতে, জোট হয় বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির সূত্র ও শর্তের ওপর নির্ভর করে। আর সেই বাস্তব হল, প্রথম ইউপিএ আমলে যত শরিক নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল কংগ্রেস, এখন তা কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। জোট রাজনীতির পরিমণ্ডলে কেন্দ্রে ফের সরকার গড়তে হলে কংগ্রেসের শরিক প্রয়োজন। তাই মমতাকে ফের জোটে চান কংগ্রেসের বহু নেতা। কেন? এর একাধিক কারণ ব্যাখ্যা করছেন তাঁরা। প্রথমত, গত কাল এবিপি নিউজ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষাতেও দেখা গিয়েছে, বামেদের ভোট কমছে। তাই এখন তাঁদের সঙ্গে জোট ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা ঠিক কাজ হবে কি না, সন্দেহ। তাতে বরং মমতা চটে যাবেন। সে ক্ষেত্রে পরে আর তাঁকে সঙ্গে পাওয়া যাবে না। কংগ্রেস নেতাদের একটি অংশ বলছে, সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলি কিন্তু কোথাও বলছে না, মমতার ভোটের হার অনেকটা কমে যাবে। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া এখনও তাঁর সরকারকে গ্রাস করতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত, সমাজবাদী পার্টি এ যাত্রায় বাঁচালেও লোকসভা ভোটের পরে তারা কী করবে, তা কেউ বলতে পারে না। বরং মুলায়ম সিংহ তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। তা ছাড়া, সপা-র আসন বাড়বে না কমবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
তৃতীয়ত, তৃণমূলের সঙ্গে জোট না হলে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ফল ভাল হবে না। সেটা পঞ্চায়েত ভোটেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। বরং লোকসভা ভোটে আলাদা লড়লে আসন সংখ্যা আরও কমে যেতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, তা হলে যে রাহুল গাঁধী রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বকে আরও আগ্রাসী হতে বলছেন এবং সংগঠন মজবুত করার দাওয়াই দিচ্ছেন? জবাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এক সদস্য বলেন, “তৃণমূলের সঙ্গে জোট কোনও ভাবেই হবে না তা স্পষ্ট করে রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের কখনও বলেননি রাহুল। তিনি যে সংগঠন মজবুত করার দাওয়াই দিয়েছেন, তাতে ভবিষ্যতে জোট হলে তৃণমূলের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে দর কষাকষি করতে সুবিধাই হবে।” সুতরাং দ্বার রুদ্ধ, এ কথা মনে করার কারণ নেই। সেটাই আজ মনে করিয়ে দিলেন মনমোহনও।

প্রশ্ন জি-২০’র

বিশ্ব বাণিজ্য ও লগ্নির পথে বিধিনিষেধ তুলতে আরও একবার অঙ্গীকার করল জি-২০ গোষ্ঠীর সদস্য রাষ্ট্রগুলি। দু’দিনের র্শীর্ষ বৈঠক শেষে উন্নত ও নতুন শিল্পোন্নত দেশগুলির এই জোট তার ঘোষণাপত্রে মন্দার কবল থেকে বিশ্ব অর্থনীতিকে বার করে আনতে অবাধ বাণিজ্যকেই হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেই কারণেই এই সব বাধা কাটানোর ব্যাপারে নিজেদের দায়বদ্ধাতার কথা নতুন করে উল্লেখ হয়েছে ঘোষণাপত্রে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.