তখন সদ্য সারদা কেলেঙ্কারি ঘটে গিয়েছে। মাস চারেক আগে সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্য নিজস্ব সঞ্চয় প্রকল্প চালু করতে চায়। ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থায় টাকা রেখে যাতে মানুষ আর সর্বস্বান্ত না হন, সে জন্যই এমন প্রকল্পের ভাবনা। বৃহস্পতিবার মহাকরণে তিনি জানালেন, আগামী ৫ অক্টোবর থেকে সেই প্রকল্প চালু করছে রাজ্য।
প্রকল্পের মূল লক্ষ্যের কথা এ দিনও জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থায় টাকা রেখে মানুষ ধনে-মানে সর্বস্বান্ত হয়ে যান। দুর্বলতর এবং সাধারণ মানুষ যাতে বঞ্চিত না হন, তাই এই প্রকল্প শুরু করছে সরকার। তাঁর কথায়, “কত সুদ পাবেন, সেটা বড় কথা নয়। জনগণের নিরাপত্তাই এই প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।” মুখ্যমন্ত্রী জানান, নতুন এই প্রকল্পের নাম হচ্ছে থ্রি-এস (সেফ সেভিংস স্কিম), বাংলায় যার নাম দেওয়া হবে আর্থিক সুরক্ষা প্রকল্প।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম এই সঞ্চয় প্রকল্প চালু করবে। তাদের হয়ে টাকা তুলবে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক। প্রাথমিক ভাবে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ইউকো ব্যাঙ্ক, ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এবং ইলাহাবাদ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে এই প্রকল্পের টাকা তোলা হবে। পরে অন্য ব্যাঙ্ক চাইলে যোগ দিতে পারে। আমানতের মেয়াদ থেকে ন্যূনতম ও সর্বোচ্চ আমানতের পরিমাণ কী হবে সব কিছুরই রূপরেখা জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী (গ্রাফিক্স দ্রষ্টব্য)। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ব্যাঙ্কের হারেই এখানে সুদ মিলবে। মিলবে কর ছাড়ও।”
গত ৮ মে মহাকরণে এই ধরনের একটি প্রকল্পের কথা প্রথম ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে সরকারের পক্ষে ওয়েবসাইটের প্রকল্পটি নিয়ে মতামত চাওয়া হয়। প্রশাসন সূত্রেই জানানো হয়, এতে কাজের মত বিশেষ আসেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রেই কটাক্ষ করা হয়েছিল উদ্যোগটি নিয়ে। এই পরিস্থিতিতে কার্যত ধামাচাপা পড়ে যায় বিষয়টি। ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবতীয় মতামত-সহ ফাইল মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছিল। এই নিয়ে সম্প্রতি আনন্দবাজারে খবর প্রকাশিত হলে ফের নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। রাতারাতি প্রকল্পটির রূপরেখা তৈরি করা হয়। বৃহস্পতিবার তারই ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
কী ভাবে সরকার এই প্রকল্প চালাবে?
অর্থ দফতরের এক মুখপাত্র জানান, মূল সঞ্চয় প্রকল্পটি চালাবে পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কর্পোরেশন (এনবিএফসি)-এর লাইসেন্স থাকার ফলে তারাই বাজারে বিভিন্ন মেয়াদের স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) ছেড়ে টাকা তুলবে। আমানতকারীদের থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের এজেন্ট-সহ ব্লক থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত অবধি বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের কাজে লাগানো হবে। প্রয়োজনে কমিশন ভিত্তিতে এজেন্ট নিয়োগ করেও আমানত সংগ্রহ করা
হবে। বিত্ত নিগমের চেয়ারম্যান অভিরূপ সরকার বলেন, “রাজ্যে এখন ২৪ হাজার স্বল্প সঞ্চয়ের এজেন্ট আছেন। তাঁদের কাজে লাগানো হবে।” তিনি মেনে নিয়েছেন, আপাতত নগদ টাকা লেনদেন করার মতো পরিকাঠামো নিগমের হাতে নেই। তাঁর বক্তব্য, “তাই ব্যাঙ্কের মাধ্যমেই আমানত সংগ্রহ করা হবে বা ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু টাকা জমা হবে নিগমের নামেই।” রাজ্য নিগমকে জানিয়ে দিয়েছে, স্টেট ব্যাঙ্কের বিভিন্ন স্থায়ী আমানতে সুদের যে হার, এই সঞ্চয় প্রকল্পে সুদের হার তার কম হওয়া চলবে না। তবে চাইলে নিগম বিভিন্ন আমানতের জন্য বাড়তি সুদ দিতে পারে। অভিরূপবাবুর বক্তব্য, “চেষ্টা করব, ব্যাঙ্কের চেয়ে কিছু বেশি সুদ দেওয়ার।”
নিগম কী ভাবে টাকা ফেরত দেবে? অর্থ দফতরের ওই মুখপাত্র জানান, নিগম বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্প এবং সাধারণ লাভজনক প্রকল্পে ঋণ দেয়। আর্থিক সুরক্ষা প্রকল্পে যে আমানত সংগ্রহ হবে, তা দিয়ে নিগম চড়া সুদে ঋণ দেবে বা অন্যত্র বিনিয়োগ করবে। সেখান থেকে যে আয় হবে, তা দিয়েই আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। নিগম সরকারি অধিগৃহীত সংস্থা। প্রকল্পটি সফল করতে সমস্ত সরকারি পরিকাঠামো ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলে, আমানতকারীদের সঞ্চয়ের পূর্ণ নিরাপত্তার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের, জানিয়েছেন ওই মুখপাত্র। ‘প্রাইজ চিট অ্যান্ড মানি সার্কুলেশন’ আইনে কেরলে এ ধরনের প্রকল্প চললেও এনবিএফসি লাইসেন্স থাকা কোনও সংস্থার মাধ্যমে টাকা তোলার উদাহরণ নেই। অর্থ দফতরের কর্তাদের দাবি, দেশে এখানেই প্রথম গ্রামীণ মানুষের জন্য নিরাপদ সঞ্চয় প্রকল্প চালু হতে চলেছে।
মুখ্যমন্ত্রী যখন এই সঞ্চয় প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন, সে সময় এর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এমনিতেই ডাকঘরের সঞ্চয় প্রকল্প রয়েছে। স্থায়ী আমানত প্রকল্প রয়েছে ব্যাঙ্কেরও। তা হলে রাজ্যের সঞ্চয় প্রকল্পে মানুষ টাকা রাখবে কেন? উত্তরে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এ দিন বলেন, “রাজ্যের প্রকল্প হওয়ার কারণে এর সার্বভৌমত্ব, একশো শতাংশ গ্যারান্টি রয়েছে।” অর্থমন্ত্রীর দাবি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চেয়ে রাজ্য সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি।
কী রকম? মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কেন্দ্র তো ইউএস-৬৪ করেছিল। তাতে ভরাডুবি হয়েছিল। তা ছাড়া, এখন তো পেনশন থেকে শুরু করে সবই তো গায়ের জোরে বাজারের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।”
বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির রমরমা বেশি হয়েছিল রাজ্যের গ্রামগুলিতেই, যেখানে এখনও পর্যন্ত ব্যাঙ্ক পৌঁছতে পারেনি। এই প্রকল্প কি পারবে মানুষের কাছে পৌঁছতে? এই প্রশ্ন অর্থ দফতরের একাংশেরও। বস্তুত, সেই সুযোগেই গ্রামে গ্রামে এজেন্ট ছেড়ে আমানত সংগ্রহ করত সারদার মতো সংস্থাগুলির এজেন্টরা। ব্যাঙ্কের মাধ্যমে প্রকল্প চালাতে গেলে যে সেই একই সমস্যা থাকছে, তা কার্যত মেনে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “গ্রামে অনেক জায়গায় ব্যাঙ্ক নেই। এ জন্য প্রয়োজনে ব্লকে ব্লকে শিবির করে টাকা তুলব।” এ ছাড়াও, রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে খুব শীঘ্র আরও দু’শো ব্যাঙ্কের শাখা খোলা হবে বলেও জানান তিনি। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ২৫টি গ্রামীণ শাখা খোলার চেষ্টা হচ্ছে। যদিও স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কার্স কমিটির (এসএলবিসি) এক সূত্র জানাচ্ছে, রাজ্যে গ্রামের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৯৪৫টি। তার মধ্যে দু’হাজারের বেশি জনসংখ্যা বিশিষ্ট ৭ হাজার ৪৫২টি গ্রামে এখন ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এ বছর আরও ২ হাজার ৪৪৪টি গ্রামে ব্যাঙ্কের সুবিধে পৌঁছনোর কথা। কিন্তু দু’হাজারের কম জনসংখ্যার ২৮ হাজার ১৪০টি গ্রামে এখনও পর্যন্ত ব্যাঙ্ক পৌঁছতে পারেনি। তবে অর্থ দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, সঞ্চয় প্রকল্পের আমানত সংগ্রহের জন্য বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে হবে। যার মাধ্যমে হাজার হাজার ছেলেমেয়েরও কর্মসংস্থান হবে।
তার পরে? এতেও যদি ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির রমরমা না কমে? মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “আমরা এ রকম একটি প্রকল্প তৈরি করব বলেছিলাম। করে দিয়েছি। এ বার কেউ টাকা ব্যাঙ্কে রাখবেন, চিট ফান্ডে রাখবেন না ডাকঘরে রাখবেন, নাকি রাজ্যের সঞ্চয় প্রকল্পে রাখবেন, সেটা তাঁদের ব্যাপার।”
|