সুপথে আইসো, না হইলে ধ্বংস হয়া যাবেন----অর্থাৎ সুপথে এসো, না হলে ধ্বংস হয়ে যাবে।
নিছক উপদেশ নয়। রাজবংশী সমাজে প্রচলিত লোককাহিনির উপরে রচিত রাজবংশীতেই লেখা ‘রাবান’ নাটকের একটি সংলাপ। নাটকের বার্তা ‘সামাজিক অবক্ষয়’। ময়নাগুড়ি কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সল্টলেকের অনীক মঞ্চে রাজ্য স্তরে আন্তঃকলেজ নাটক প্রতিযোগিতায় ৮ সেপ্টেম্বর এই নাটকটি অভিনয় করবেন।
নাটকের কাহিনি আপাত ভাবে রামায়ণ ভিত্তিক লোককথা হলেও মূল সুরটি বাঁধা হয়েছে সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিবাদ হিসেবেই। নাট্যকার দীনেশচন্দ্র রায় সামাজিক অবক্ষয় ও দুর্নীতিকে রাবণ রূপে কল্পনা করেছেন। তাই রাজবংশীতে নাটকের নামকরণ করেছেন ‘রাবান’। তাঁর কথায়, “রাবণের জীবনে বেড়ে চলা কামনা বাসনা যেমন ধ্বংসের কারণ হয়েছিল, সেটাই আমাদের সমাজে ঘটছে লোককাহিনিকে সামনে রেখে। নাটকে তা বলার চেষ্টা করেছি।”
বিলুপ্ত প্রায় ‘ডমনা’ নৃত্যের ছন্দে শুরু নাটকে রামায়ণের সঙ্গে সূক্ষ্ম ভাবে মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে বর্তমান সময়ের। সীতাকে উদ্ধারের পরে রামচন্দ্র বিভীষণ ও সুগ্রীবকে রাজা করতে গেলে নাটকের মোড় ঘুরে যায়। সমস্ত বাঁদর ও হনুমান প্রশ্ন তোলে, ওঁরা দু’জন রাজা হলে তারা কেন বঞ্চিত হবে? যুক্তি হিসেবে কপিবাহিনী জানায়, সীতাকে উদ্ধার করে আনতে তারাও তো কম পরিশ্রম করেনি। তাই পুরস্কার মেলা উচিত। রামচন্দ্র ওই সময় ‘তোমরা সবাই কলিযুগে রাজা হবে’ বলে পরিস্থিতি সামলে নেন।
এর পরেই ৫৩ মিনিটের নাটকে চুম্বকে ধরা দেয় প্রাক ব্রিটিশ যুগ, ব্রিটিশ যুগ এবং বর্তমান সময়কাল। মহাদেবকে সঙ্গে নিয়ে রামচন্দ্র এক যুগ থেকে অন্য যুগে ঘুরে দেখেন, কেমন করে সেদিনের কপিবাহিনী রাজা হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে মরছে। রাজতন্ত্রের অবসান হয়ে ভারত ব্রিটিশের পদানত হচ্ছে। রাজাদের পরিণতি দেখে খেপে রামচন্দ্র এক সময় বলবেন, ‘এককে হিঞ্জারি তামান রাজাগুলা মরি গেইল!’ অর্থাৎ এক সঙ্গে সব রাজা শেষ হয়ে গেল।
তখনই মহাদেব সতর্ক করবেন, ‘এলাও সময় আছে সুপথে আইসো।’
কিন্তু শুনছে কে? সেই কপিকুলকে বর্তমান সমাজের বিভিন্ন স্তরে দেখা যাবে প্রভাব প্রতিপত্তিশালী রূপে। দুর্নীতিও বাড়ন্ত। ফের মহাদেব সতর্ক করবেন।
শিক্ষক মানিক শর্মা এবং তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বিধান চক্রবর্তীর নির্দেশে কলেজ প্রেক্ষাগৃহে নাটকের মহড়ায় ওই সতর্কতা যেন ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে যায়। তাঁরা জানান, দুর্নীতি সামাজিক ব্যাধি। নাটকের মধ্যে দিয়ে ওই ব্যধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা। তৃতীয় বর্ষের চিরঞ্জিত রায়, উজ্জ্বল রায়, বিধান চক্রবর্তী, দ্বিতীয় বর্ষের ঝিমি রায় বসুনীয়ার মতো অভিনয় করবেন ১৯ জন। তাঁরাও আপ্লুত অভিনয়ে সুযোগ পেয়ে। নাটকে চারটি গান লিখেছেন কামেশ্বর রায়। কলেজের অধ্যক্ষ দেবকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, “উত্তরের গ্রামীণ মানুষের মন সহজে স্পর্শ করার জন্য আমরা রাজবংশীতে নাট্যচর্চা শুরু করেছি। গত বছর ‘নর লোকের চিত’ নামে নাটক মঞ্চস্থ করে সেরা পুরস্কারও পেয়েছি।” |