কোনও মহিলা চেষ্টা করলে হয়তো হিমালয়ও পেরোতে পারবে। কিন্তু এই দেশে কোনও মহিলার পক্ষে বাড়ির চৌকাঠ পেরোনোও অসম্ভব।
নিজেই লিখেছিলেন তিনি। আবার নিজেই সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন।
কাবুলিওয়ালার বাঙালি বৌটি শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে তালিবানি বন্দুকের সামনে থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন নিজের দেশে। একার চেষ্টায়। নিজের হাতে সেই কাহিনি লিখে রাতারাতি হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয় লেখিকা। আট বছর পরে সন্দেহভাজন তালিবানের গুলিতেই শেষ হয়ে গেল ৪৯ বছরের জীবন।
সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাণ হারালেন আফগানিস্তানের মাটিতেই।
কাবুল থেকে প্রায় ১৮ ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে গজনী এলাকার শারানা শহরে ছিল সুস্মিতার শ্বশুরবাড়ি। আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্বে পাকটিকা প্রদেশের সদর শহর এটি। বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা বিবিসি আফগান পুলিশ সূত্র উদ্ধৃত করে প্রথম জানায়, সম্ভাব্য তালিবান জঙ্গিরা বুধবার রাতে সুস্মিতাদের বাড়িতে হানা দিয়েছিল। সুস্মিতার স্বামী জানবাজ খান এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের হাত-পা বেঁধে রেখে সুস্মিতাকে বাইরে বের করে নিয়ে যায় তারা। তার পর তাঁকে গুলি করে মেরে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার সামনে ফেলে রেখে চলে যায়।
আফগান পুলিশের তরফে সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে জানানো হয়েছে, আফগানিস্তানে ‘সাহাবকামাল’ নামে পরিচিত সুস্মিতাকে ২০ বার গুলি করা হয়েছিল। উপড়ে নেওয়া হয়েছিল মাথার বেশ কিছু চুল। এতটা হিংস্র আক্রোশের কারণ? পাকটিকা প্রদেশের পুলিশ প্রধান দওলত খান জাদরানের কথায়, “প্রাথমিক তদন্তে আমাদের অনুমান, অতীতে সুস্মিতা যে সব কথা লিখেছিলেন/বলেছিলেন, তার থেকে সিনেমাও হয়েছিল...সেই পুরনো রাগের শোধ তুলতেই হত্যা।” |
প্রথম বার আফগানিস্তানে যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির গ্রামে তোলা ছবি।
কলকাতায় সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই ছবিটি দেখিয়েছিলেন ২০০৩ সালের ৬ মার্চ। |
নিজের কলমই কি তবে সুস্মিতার মৃত্যুর কারণ হল? তালিবানের বিরুদ্ধে মুখ খোলার খেসারত দিলেন নিজের প্রাণ দিয়ে? সুস্মিতার অনুরাগী পাঠকদের মনে এই কথাটাই এখন ঘোরাফেরা করছে সবচেয়ে বেশি। ফিরে আসছে বছর ১৫ আগের স্মৃতি।
১৯৯৮ সাল। প্রকাশ পেল ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’। তুমুল হইচই, বেস্টসেলার। নিমেষের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন সুস্মিতা। তার আগে বাঙালি পাঠক রবি ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’কে চিনত। বাঙালি দর্শক জানতেন আলখাল্লা-পরা ছবি বিশ্বাসকে। কিন্তু সুঠাম-সুপুরুষ কাবুলির সঙ্গে কলকাতার মেয়ের প্রেমকাহিনি? সেই প্রথম সামনে এল। তার সঙ্গে তালিবানি আফগানিস্তান থেকে বন্দুকের সঙিনের সামনে দিয়ে একা মেয়ের দেশে ফেরার রোমহর্ষক উপাখ্যান। সুস্মিতার জেদ, সুস্মিতার সাহস, সুস্মিতার অকুণ্ঠ লেখনী বাঙালিনির ললিতলবঙ্গলতা আদলকে একেবারে ঝাঁকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
সুস্মিতার কথা ভাবলে অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়ের সর্বপ্রথম যে শব্দটা মাথায় আসে, সেটা ‘দুঃসাহসী’। সুস্মিতার জীবন নিয়ে একটা ছবিতে অভিনয় করার কথা ছিল ওঁর। মহরত হওয়া সত্ত্বেও ছবিটা শেষ অবধি হয়নি যদিও। তবে হিন্দিতে ‘এসকেপ ফ্রম তালিবান’ নামে একটি ছবি হয়, তাতে অভিনয় করেন মনীষা কৈরালা। কবি সুবোধ সরকার মনে করতে পারেন, “সুস্মিতাকে এক বার বলেছিলাম, আপনাকে তো তালিবানরা খুন করবে। হালকা ভাবে কথাটা নিয়ে মুচকি হেসে বলেছিলেন, পারবে?”
এখন নিষ্ঠুর পরিহাসের মতো হয়ে উঠছে সেই স্মৃতি। মৌলবাদী ফতোয়া মাথায় নিয়ে দেশছাড়া আর এক লেখিকা তসলিমা নাসরিন খবরটা শুনে বলেন, “সুস্মিতা আমার বাড়িতে বেশ কয়েক বার এসেছিলেন। অনেক কথা হত। আমার ধারণা, ওঁকে মারার পিছনে গভীর কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে। ওঁর শ্বশুরবাড়িকেও সন্দেহের বাইরে রাখা চলে না।” কিন্তু সব কিছুর আগে সাহিত্যজগতের মনে একটাই প্রশ্ন, কেন আফগানিস্তানে ফিরেছিলেন সুস্মিতা? অত কাণ্ড করে, অত ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরার পরে আবার কেন গেলেন? নইলে তো এ ভাবে মরতে হত না! সমরেশ মজুমদার বলছেন, “এ তো আত্মহত্যার সামিল!”
আত্মহত্যা নয়। প্রকাশক স্বপন বিশ্বাস জানাচ্ছেন, নতুন লেখার রসদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই সুস্মিতার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া। অর্থাৎ, সেই লেখনীর টান! সঙ্গে জুটে গিয়েছিল একটা চাকরিও। স্বাস্থ্য-কর্মীর চাকরি। ফেব্রুয়ারি মাসে আফগানিস্তান যাওয়ার আগে দিল্লি বিমানবন্দরে বসেই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন কলকাতার এক সাংবাদিককে। তখনই জানান চাকরির কথা। পাশ করা ডাক্তার ছিলেন না সুস্মিতা। কিন্তু আফগানিস্তানে থাকতে ডাক্তারি বই পড়ে পড়ে আশাপাশের মেয়েদের ওষুধ দিতেন। ভিড়ও হত। চিকিৎসা পরিষেবার বেহাল দশার মধ্যে সুস্মিতার ওষুধই ছিল ওখানকার মেয়েদের বড় ভরসা। সেই অভিজ্ঞতাই আগেও এক বার চাকরির প্রস্তাব ডেকে এনেছিল। সুস্মিতা নেননি। কিন্তু এ বার নিয়েছিলেন। তালিবান-উত্তর জমানায় আফগানিস্তানকে এক বার ভিতর থেকে দেখার সুযোগ ছাড়তে চাননি। শ্বশুরবাড়ির দেশকে জানবার যে অপার কৌতূহল নিয়ে ১৯৮৮ সালে তিনি প্রথম বার স্বামীর সঙ্গে আফগানিস্তান যান, সেই কৌতূহল তাঁকে টান দিয়েছিল এ বারেও।
কৌতূহল, সাহস আর জেদ সুস্মিতার বরাবরের সঙ্গী। সে কাবুলিওয়ালার প্রেমে পড়াই হোক, বাপের বাড়িতে মারধর খেয়েও জানবাজকে বিয়ের সিদ্ধান্তে অনড় থাকাই হোক আর জানবাজ কিচ্ছু না বলে কলকাতায় চলে আসার পরে কট্টর রক্ষণশীল শ্বশুরবাড়িতে নিজের মতো বাঁচার চেষ্টা চালানোই হোক।
আফগানিস্তানে সে সময় এক দিকে সোভিয়েত বাহিনীর দাপাদাপি, অন্য দিকে মুজাহিদদের লড়াই। প্রত্যেক বাড়িতে মজুত একে-৪৭। তার পরের বছরগুলোতে চোখের সামনেই তালিবান শক্তির উত্থান। ১৯৯৫ সালে পালানোর জন্য পাকাপাকি ভাবে মনস্থির করলেন। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে পাকিস্তান অবধি এসেও পৌঁছলেন। আসার পথে মুক্তির আনন্দে ফাঁকা রাস্তায় গান ধরেছিলেন, ‘ও আমার দেশের মাটি..।’ কিন্তু পাসপোর্ট-ভিসা না পেয়ে দেশের মাটিতে পা রাখা হয়নি। শ্বশুরবাড়ি ফিরতে হল। ঘর-পালানো বৌয়ের তখন বন্দিজীবন। দেওয়ালে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে আবার পালানো, তালিবান বাহিনীর মুখে পড়া, সেখান থেকে কোনও মতে পালিয়ে দিল্লি পৌঁছনো সুস্মিতার কাহিনি সিনেমাকে বাস্তবিকই হার মানিয়েছিল।
কলকাতায় এসে জানবাজের সঙ্গেই সংসার করছিলেন সুস্মিতা। পাশাপাশি চলছিল লেখালেখি। গত বছর মধ্য কলকাতায় অপেরা সিনেমা হলের কাছে জানবাজের এক ভাইয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। এ দিন সেই ভাইয়ের পড়শি, কাবুলিওয়ালা দিনার খান বলেন, “ভাইয়ের মৃতদেহ নিউ মার্কেট থানা থেকে কবরস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় জানবাজের সঙ্গে সুস্মিতাও এসেছিলেন। গাড়িতে বসেছিলেন। ওই এক ঝলক দেখা। আর যোগাযোগ ছিল না ওঁদের সঙ্গে।” কলকাতার কাবুলি মহল্লার সঙ্গে জানবাজ-সুস্মিতার যোগাযোগ কিছুটা ক্ষীণ হয়েই এসেছিল।
ফেব্রুয়ারিতে জানবাজের সঙ্গেই আফগানিস্তান যান সুস্মিতা। আশা ছিল, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হবে। স্বাস্থ্য-কর্মীর চাকরিটা করছিলেন। সঙ্গে ওখানকার মেয়েদের জীবনযাত্রার ছবিও তুলছিলেন। বলে গিয়েছিলেন, ছ’মাসের জন্য যাচ্ছেন। তালিবান-উত্তর আফগানিস্তান নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবেন।
২০টা গুলি সেই স্বপ্নকে খুন করে দিয়ে গেল। তালিবানের বন্দুক মালালা ইউসুফজাইকে থামাতে পারেনি। কিন্তু বাঙালি বৌটি এ বার আর পালাতে পারলেন না।
|