শিশুর জন্মের জন্য হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে দেশের মধ্যে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যওয়াড়ি তালিকায় এ রাজ্যের স্থান ১৪ নম্বরে। দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলির জন্য কেন্দ্রের ‘আয়ুষ্মতী’ প্রকল্প সফল হলে অবস্থা বদলাবে বলে আশা ছিল। কিন্তু পাঁচ বছরের মধ্যে সেই প্রকল্পও মুখ থুবড়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গ আয়ুষ্মতী প্রকল্প ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চেয়ে কেন্দ্রের কাছে আবেদন করেছে।
কেন্দ্রীয় এই প্রকল্পে ঠিক হয়েছিল, দারিদ্রসীমার নীচে থাকা বা তফসিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত পরিবারগুলির জন্য কিছু বাছাই করা বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে প্রসবের খরচ দেবে কেন্দ্র। স্বাভাবিক প্রসব এবং সিজার বা অস্ত্রোপচার করে প্রসব, দুয়ের ক্ষেত্রেই এই সুবিধা মিলবে। কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য ছিল, সারা দেশেই গ্রামের দিকে সরকারি হাসপাতালগুলিতে পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। সেখানে রোগীর চাপে অনেক সময় আসন্নপ্রসবাকে শয্যা দেওয়া যায় না। আবার অনেক জায়গায় গর্ভবতী শয্যা পেলেও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, সার্জন বা অ্যানাস্থেটিস্টের অভাবে সিজার করা যায় না।
এই মুশকিল আসানেই ‘আয়ুষ্মতী’ প্রকল্পের জন্ম।
জাতীয় পরিবার-স্বাস্থ্য সমীক্ষা (৩) অনুযায়ী, হাসপাতালে শিশু-জন্মের হারে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে ১৪তম রাজ্য। এ রাজ্যে হাসপাতালে শিশু-জন্মের হার ৪১%, যা জাতীয় হারের (৪৭%) চেয়েও কম। প্রথম স্থানে কেরল, ১০০%। দ্বিতীয় স্থানে গোয়া, ৯৩% এবং তৃতীয় স্থানে তামিলনাড়ু, ৯০%।
কেন এই অবস্থা? স্বাস্থ্যকর্তাদের ব্যাখ্যায়, কেরল বা তামিলনাড়ুর মতো এ রাজ্যে সাব-সেন্টারে ডেলিভারি হয় না। ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্তর থেকেই চিকিৎসকের অভাব। যেখানে সিজার হওয়ার কথা, সেখানে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, সার্জন বা অ্যানাস্থেটিস্টের অভাব। ফলে গ্রামীণ হাসপাতাল, মহকুমা বা জেলা হাসপাতাল থেকেও প্রসূতিকে রাতবিরেতে রেফার করা হয়। কিন্তু প্রসূতিকে নিয়ে যাওয়ার বিশেষ গাড়ি ‘নিশ্চয়যান’ রাজ্যে চালু করা যায়নি। জননী সুরক্ষা যোজনায় যে টাকা দেওয়ার কথা, তা-ও বহু জায়গায় দেওয়া হচ্ছে না। ফলে বাড়িতে দাইয়ের সাহায্যে প্রসব করানোর রীতিও বন্ধ হচ্ছে না। তবে রাজ্যের মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের এক উচ্চপদস্থ কর্তার দাবি, কেন্দ্রের ওই সমীক্ষার পর চার-পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের গড় এখন ৭০%-এর কাছাকাছি।
কিন্তু আয়ুষ্মতী থেকে মুখ ফেরানোর কারণ কী? রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা জানাচ্ছেন, বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলি ‘আয়ুষ্মতী’র জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি করতে আগ্রহ দেখায়নি। পাঁচ বছরে সাকুল্যে ৭৭টি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করতে পেরেছে সরকার। দক্ষিণ দিনাজপুর, পুরুলিয়া, মালদহের মতো জেলায় চুক্তি করার মতো একটিও হাসপাতাল মেলেনি! কেন? এ বার পশ্চিমবঙ্গ যে অভিযোগটা তুলছে, সেটা তার একার নয়। অন্যান্য রাজ্য থেকেও এই অভিযোগ কেন্দ্রের কাছে জমা পড়েছে।
রাজ্যগুলির বক্তব্য হল, স্বাভাবিক প্রসব এবং ‘সিজার’ করে প্রসব, দু’ক্ষেত্রেই একই ভাবে ৩২০০ টাকা করে ধার্য করেছে কেন্দ্র। এত কম টাকায় ‘সিজার’ করতে রাজি নয় বেসরকারি সংস্থাগুলি। স্বাস্থ্য দফতরের সদ্য প্রাক্তন মুখপাত্র শিখা অধিকারী বলেন, “অনেক বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোম সরকারের থেকে টাকা নেওয়ার পরেও প্রসূতির বাড়ির থেকে লুকিয়ে টাকা নিচ্ছে। এতে গরিব মানুষ উপকৃত হওয়ার বদলে ঠকছেন। টাকা না বাড়ালে চুক্তি করার হাসপাতালও মিলছে না। কেন্দ্রকে তা জানিয়ে বেরিয়ে আসার কথা বলে দেওয়া হয়েছে।” কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের পাল্টা অভিযোগ, “পশ্চিমবঙ্গ এই প্রকল্প নিয়ে যথেষ্ট প্রচার চালায়নি। চুক্তির জন্য বেসরকারি হাসপাতাল খোঁজার চেষ্টা করেনি। যে ক’টির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে তারা ঠিক মতো কাজ করছে কি না, নজরদারি করেনি।”
তবে টাকার পরিমাণ যে কম, সে কথা স্বীকার করছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক। তাদের স্বীকারোক্তি, “এর থেকে বেশি টাকা দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের নেই।” পাশাপাশি আরও একটা যুক্তি দিচ্ছে মন্ত্রক। “সাধারণ ডেলিভারির তুলনায় সিজারের জন্য বেশি টাকা দিলে বেসরকারি হাসপাতালগুলি ইচ্ছাকৃত ভাবে সিজার বেশি করবে।” এই যুক্তিটা আবার পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারছেন না রাজ্যের স্বাস্থ্য কর্তারাও। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য হল, এতে করে প্রকল্পটাই যে মুখ থুবড়ে পড়ছে! এ ব্যাপারে দিল্লির বক্তব্য, “যে ক’টি বেসরকারি হাসপাতাল এই টাকায় রাজি হচ্ছে, অন্তত সে ক’টিতেও যদি কয়েক হাজার মায়ের ‘সিজার’ হয়, সেটাও লাভ!” পশ্চিমবঙ্গে ২০১২-১৩ সালে আয়ুষ্মতী প্রকল্পের আওতায় প্রসব হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার মহিলার।
তা হলে পশ্চিমবঙ্গ ওই প্রকল্প থেকে সরে আসতে চাইছে কেন? স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, যথেষ্ট বেসরকারি হাসপাতাল পাওয়া যাচ্ছে না বলে কেন্দ্রের দেওয়া টাকা পশ্চিমবঙ্গ পুরোটা খরচ করতে পারছে না। এবং তাঁরা স্বীকার করছেন, এ ক্ষেত্রে শুধু টাকার অঙ্কটাই সমস্যা নয়। জেলাস্তরে বহু জায়গায় ভাল বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমই নেই। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় উত্তরপ্রদেশ-অরুণাচল-ঝাড়খণ্ড-বিহারের মতো একাধিক রাজ্যও এই সমস্যার কথা কবুল করেছে।
এ ব্যাপারে পরিকল্পনার স্তরেই যে ভুল থেকে গিয়েছে, সে কথা মানছেন কেন্দ্রীয় কর্তারা। কেন্দ্রের প্রসূতি স্বাস্থ্য বিভাগের ডেপুটি কমিশনার হিমাংশু ভূষণ বলছেন, “ডেলিভারির জন্য বেসরকারি হাসপাতালকে সরকারের দেওয়া টাকা সত্যিই কম। দেশের যে সব ব্লকে সরকারি পরিকাঠামো সবচেয়ে খারাপ শুধু সেখানেই এই প্রকল্প সীমাবদ্ধ রাখলে ভাল হত। তাতে হয়তো ডেলিভারির জন্য টাকাটাও একটু বাড়ানো যেত। শহরাঞ্চলে এই প্রকল্পের তেমন দরকার ছিল না।”
|