স্বাধীনতা দিবসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছাবার্তা তত ক্ষণে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। কলকাতায় ছুটির দুপুরে কড়াইশুঁটির পোলাও আর স্পেশ্যাল চিকেন কারি খেয়ে ডেভিড ক্যামেরন দিব্যি ভাতঘুম দিলেন।
ইদানীং রোজই ছুটি ডেভিডের। সকালে ঘুম থেকে উঠে বা দুপুরে বিশ্রামের পরে বড়জোর বিছানায় ভর দিয়ে একটু ওঠার চেষ্টা করেন। ৮৪ বছরের পায়ে সেই জোর কই! ধরে-ধরে বারান্দা অবধি পৌঁছনোর ধকলও সয় না। বিছানায় বসেই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়া এক ফালি রোদ গায়ে মাখেন। কেউ ডাকলে কদাচিৎ দু-একটা অস্ফুট শব্দ বা ঘাড় হেলিয়ে লাজুক হাসি! বৃদ্ধাবাসের কর্ত্রী, মেরি মার্টিন আদর করে ক্যামেরনকে বলেন, ‘আমার সব থেকে বাধ্য বাচ্চা!’
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে কলকাতার ডেভিড ক্যামেরনের নিস্তরঙ্গ জীবন এক ফোঁটা মিলবে না।
কয়েক দশকের পুরনো বন্ধু নিল ও’ব্রায়েন তবু কলকাতার ক্যামেরনের জীবনকেও কম বর্ণময় বলতে রাজি নন। প্রাক্-স্বাধীনতা যুগের হায়দরাবাদে নিজামের সেনাবাহিনীর সদস্য! নকশাল আমলে কলকাতার নামী স্কুলের দাপুটে প্রিন্সিপাল! কিংবা ম্যাকলাস্কিগঞ্জের বিজন প্রান্তরে ঘোড়াশালের মালিক! নিলের কথায়, “এক জীবনে নিজের খেয়ালখুশিতে যত রকম ভাবে বাঁচা সম্ভব, বেঁচে নিয়েছে আমার বন্ধুটি! ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর নামমহিমায় নয়, ক্যামেরন তার নিজের জোরেই স্পেশ্যাল।” |
দুই ক্যামেরন। কলকাতা ও লন্ডনের। ছবি: সুদীপ আচার্য। |
বছর তিনেক আগে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ডেভিড ক্যামেরন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন। তখন কিন্তু বেজায় মজা পেয়েছিল কলকাতার ডেভিড ক্যামেরনের পরিবার। ডেভিডের বড় ছেলে রডরিক ক্যামেরন হাসেন, “এই নামটা নিয়ে আমাদের মধ্যে হাসাহাসি চলে! জানেন, আমার পুত্রের নামও ডেভিড ক্যামেরন!”
কয়েক বছর আগে মনমোহন সিংহের ‘নেমসেক’ হিসেবে খবরে এসেছিলেন বেঙ্গালুরুর বৃদ্ধ ডাকটিকিট বিক্রেতা। আর হায়দরাবাদের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিবারের ছেলে ডেভিড ক্যামেরন আজীবন ঘুরপাক খেয়েছেন কিনিয়া থেকে কলকাতা! স্কুল শিক্ষকতা, ইংরেজি পাঠ্যবই লেখালেখি থেকেই খিদিরপুরে সেন্ট টমাস স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ভূমিকায়। যেখানে তাঁর দাপটের কথা এখনও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন অনেকেই।
ওই স্কুলেরই আর এক প্রাক্তন প্রধানশিক্ষক ডেভিড হাওয়ার্থ বলছিলেন, স্কুলের কঠিন সময়ে ক্যামেরন ছিলেন যোগ্যতম প্রিন্সিপাল। নকশাল আন্দোলনের যুগে ডাকাবুকো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতেন। খিদিরপুর ছাড়াও হাওড়ার সেন্ট টমাস চার্চ স্কুলের দায়িত্বও নিজের ঘাড়ে নিয়েছিলেন। স্কুলের এস্টেট অফিসার অশোককুমার রাহা মনে রেখেছেন, বড় মনের মানুষটিকে। ’৭৮-এর বন্যার সময়ে জাতধর্ম নির্বিশেষে একবালপুর-খিদিরপুরের দুর্গতদের ঠাঁই দিতে যিনি স্কুলবাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন। একদা সেন্ট টমাসের সহকর্মী-শিক্ষক তথা ঘোড়দৌড়ের মাঠের সঙ্গী, আমিন মির্জার মনে পড়ে কলকাতার রেসের চ্যাম্পিয়ন মিডনাইট কাউবয়কে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ নিয়ে যাওয়ার জন্য কেমন খেপে উঠেছিলেন ক্যামেরন।
ঠিকই। দেশ-বিদেশের ঘোড়া আমদানি করে প্রবীণ মানুষটি ম্যাকলুস্কিগঞ্জে তেজি রেসের ঘোড়া লালনের আস্ত একটা আস্তাবল খুলে ফেলেছিলেন। প্রৌঢ় বয়সে পরিবারের সবাই যখন অস্ট্রেলিয়ায় থিতু হতে ব্যস্ত, ক্যামেরন সাহেব তখন নিজের নতুন স্কুলের পত্তন করছেন!
বাপের মতোই ঘোড়া-পাগল পুত্র রডরিক। বাহরিনে রাজার ঘোড়াশালে কাজ করেন। তিনি বলেন, “জীবনে অনেক কিছু করলেও জন্মভূমির প্রতি টানটাই বোধহয় বাবার কাছে পয়লা নম্বর।” স্ত্রী এঞ্জেলা, ছোট ছেলে জন ও কন্যা মারিয়া এখন পার্থ-বাসী, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। এঞ্জেলা বলেন, “মাঝেমধ্যে ডেভিড আমাদের কাছে এলেও ভারতীয় নাগরিকত্ব ছাড়েনি। অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া, পরিবেশ ওর মনে ধরেনি! বছর পাঁচেক আগে এসে এক বার খুব অসুখে ভুগল! তার পর থেকে আর আসতে চায় না!”
পরিবার মর্যাদা দিয়েছে ক্যামেরন সাহেবের ইচ্ছেকে। সেন্ট টমাস স্কুল লাগোয়া মেরি কুপার বৃদ্ধাবাসই এখন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষকের ঠিকানা। অনেক দিনের সুহৃদ অশোকবাবু তাঁর লোকাল গার্জেন। তিনিই বলছিলেন, ২০১০-এর মে-তে ক্যামেরন ব্রিটেনের তরুণতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথের কিছু দিন পর থেকেই কলকাতার ক্যামেরনের শরীরে বার্ধক্য থাবা বসাচ্ছে। স্মৃতিটাও প্রায় উবে গিয়েছে।
পুত্র রডরিক তা পুরোপুরি মানতে রাজি নন। “গত বছর কলকাতায় এসে দেখি বাবা আমায় চিনতে পারছে না। মায়ের ছবি দেখাতেই এক গাল হাসি!” রডরিকের কথায়, “মনে হয়, বর্তমানটা মিথ্যে হয়ে বাবার কাছে এখন দূর অতীতটাই সত্যি। যখন ওঁর বা-মায়ের বয়স কম, আমরাও পুঁচকে!” বিলেতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নামতুতো মিল যা-ই থাক, পুত্রপ্রতিম ডেরেক ও’ব্রায়েনের কাছে এই ডেভিড ক্যামেরন খাঁটি ভারতীয়। রংবেরঙের স্বপ্নের টানে ছুটে বেড়িয়েও যাঁর জীবনদর্শন, ‘আমার এই দেশেতে জন্ম, যেন এই দেশেতেই মরি!’ |