নয়ডায় গণধর্ষণে
এ বার পুলিশই, ধৃত ৪
ক্ষকই ধর্ষক এ বার রাজধানীতে। নির্ভয়া গণধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত নাবালকের শাস্তি ঘোষণা হল আজ। আর তার আগের সন্ধেয় ঘটে গেল আর এক গণধর্ষণের ঘটনা। দিল্লি এলাকার লাগোয়া নয়ডায় দিল্লিবাসী বছর পঁচিশের এক তরুণীকে ধর্ষণ করল পাঁচ জন। এদের মধ্যে দু’জন প্রভিন্সিয়াল আমর্র্ড কনস্টাবুলারি (পিএসি)-র পুলিশ। আজ সকালে ওই তরুণী থানায় অভিযোগ দায়ের করার পরে দুই পুলিশ-সহ চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পঞ্চম জনের খোঁজে চলছে তল্লাশি।
গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে এক প্যারামেডিক্যাল ছাত্রীকে গণর্ধষণ করে খুনের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছিল দিল্লি-সহ গোটা দেশ। মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন সংশোধনও করতে হয়েছে সরকারকে। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা যে তাতে বন্ধ হয়েছে বা কমেছে, তেমনটা নয়। বরং প্রাক্তন পুলিশকর্তা থেকে মনোবিদ, সমাজকর্মী থেকে আমজনতা, অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, দোষীদের শাস্তি তো পরের কথা, পুলিশই যদি ধর্ষক হয়ে ওঠে, তবে মানুষ সুরক্ষা চাইবে কার কাছে?
পুলিশ জানিয়েছে, শুক্রবার সন্ধ্যায় নয়ডার এক ব্যবসায়ী বন্ধুর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন দিল্লির পুরনো শাহদরা এলাকার বাসিন্দা ওই তরুণী। নয়ডার সেক্টর-১০৫-এর বি ব্লকে সেই ফ্ল্যাটে সন্ধে ৭টা নাগাদ আচমকাই তিন সঙ্গীকে নিয়ে চড়াও হয় দুই পুলিশ। তরুণীর বয়ানে জানা গিয়েছে, পিএসি-রই জিপে করে এসেছিল ওই পাঁচ জন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তরুণীর বন্ধুকে বেধড়ক মারধর করতে শুরু করে তারা। তার পরে তরুণীকেও মারধর করে ও তাঁকে একের পরে এক ধর্ষণ করে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, ধর্ষণের পরে তরুণীর মোবাইল ফোন এবং এটিএম কার্ড নিয়ে চম্পট দেয় অভিযুক্তরা। এর পর ওই এটিএম কার্ড ব্যবহার করেই তারা জিপে তেল ভরেছে বলে জানা গিয়েছে।
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছে, পাঁচ অভিযুক্তের মধ্যে এক জন ওই ফ্ল্যাটেরই বাসিন্দা। বেশ কিছু দিন ধরেই পুলিশে চাকরি পাওয়ার প্রস্তুতি চালাচ্ছিল সে। সেই সূত্রেই পুলিশ বিভাগের কিছু কর্মচারীর সঙ্গে চেনা-জানা হয়েছিল। ঘটনার দিন সে-ই পিএসি-র দুই কনস্টেবলকে ডেকে নিয়েছিল। তাদের সঙ্গে ছিল আরও দু’জন।
দিল্লির পুলিশ সুপার যোগেশ সিংহ জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই অভিযুক্ত দুই কনস্টেবল-সহ চার জন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁর কথায়, “খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তদন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে। চার জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এক জন পিএসি-র হেড কনস্টেবল বংশীরাম শর্মা এবং আর এক জন কনস্টেবল সুভাষ। অন্য দু’জন তাদের বন্ধু, বান্টি এবং অরুণ কুমার।” পঞ্চম অভিযুক্ত জিতু পলাতক। পিএসি-র যে জিপটিতে অভিযুক্তরা এসেছিল, সেটিও আটক করা হয়েছে। নয়ডার সেক্টর-৩৯ থানায় ধর্ষণ, ডাকাতি ইত্যাদি অভিযোগে একাধিক ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে ধৃতদের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ দায়ের হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অভিযুক্তদের ৪ জনকে পাকড়াও করে পুলিশ আজ তৎপরতা দেখালেও রাজধানীর বুকে নারী-সুরক্ষার প্রশ্নটি আরও গুরুতর হয়ে উঠল। নয়ডার ঘটনা নিয়ে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখে শোনা গেল আম-জনতার প্রশ্নটাই, “অপরাধীদের যে সাজা দেবে, সে-ই যদি ধর্ষক হয়, লোকে যাবে কোথায়?” কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার গৌতম চক্রবর্তী মনে করালেন, অন্য ধর্ষণকারীর চেয়ে ধর্ষক পুলিশ অনেক বেশি বিপজ্জনক। কারণ অন্যান্য দুষ্কৃতীর চেয়ে আইন ও তার প্রয়োগের ফাঁকফোকর সম্পর্কে তারা অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। তাই “পুলিশের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে কঠোর শাস্তিটাই শেষ কথা নয়। দ্রুত সেই শাস্তি নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় কথা” বললেন তিনি। তাঁর মতে, এ সব ক্ষেত্রে তদন্তকারী অফিসার ও যিনি মামলাটির তদারকি করছেন, উভয়েরই দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। কারণ, মানুষ দেখছে ধর্ষণ করেছে পুলিশ। তদন্তে নেমে সহকর্মীরা তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাবে, এমন একটা আশঙ্কা জনমানসে থাকেই। তাই এই ধরনের মামলায় দোষীর যাতে শাস্তি হয়, এমন ভাবে চাজর্র্শিট তৈরি করা ও ধর্ষিতা আর তাঁর স্বজনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা বিশেষ জরুরি।
রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারম্যান সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ও সেই শাস্তির নিশ্চয়তার উপরেই জোর দেন। তিনি বলেন, “সারা দেশে আইন ভাঙাটাই পুলিশের অভ্যাস। ধর্ষকের যা শাস্তি, অভিযুক্তদের সেই শাস্তিই হওয়া উচিত। কিছুতেই যেন লঘু না হয়।”
ধর্ষণের দায়ে পুলিশের শাস্তির কয়েকটি নজির রয়েছে পশ্চিমবঙ্গেই। ১৯৯২ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে ফুলবাগান থানার কনস্টেবল নীলকমল ঘোষ-সহ ৬ পুলিশ নেহার বানু নামে এক মহিলাকে গণধর্ষণ করেছিল। পাশের মহল্লা থেকে তাঁকে থানার দেড়তলায় কনস্টেবলদের ঘরে তুলে এনে ওই কুকীর্তি করে তারা। ওই মামলায় পরে ৩ জনের যাবজ্জীবন ও ২ জনের ১০ বছর করে জেল হয়। বাকি এক জন ছাড়া পান মানসিক ভাবে অসুস্থ প্রমাণিত হওয়ায়। এর পরে ১৯৯৫ সালে জোড়াসাঁকো থানার সার্জেন্ট তমাল ঘোষ স্ট্র্যান্ড রোড থেকে ফুটপাতবাসী এক তরুণীকে হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবন চত্বরে নিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। তার শাস্তি হয় পরে। আবার রিজার্ভ ফোর্সের পুলিশরাই পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় এগিয়ে আসায় সার্জেন্ট বাপি সেনকে। এ ঘটনা ২০০২ সালের।
নয়ডা-কাণ্ডের কথা জেনে বিচলিত সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “এখন যাহা মুম্বই, তাহাই দিল্লি, তাহাই কলকাতা। পুলিশ রক্ষকের চাকরি করলেও মানুষ, লোলুপ মানসিকতা তারও রয়েছে। যে সমস্ত পুরুষ নারী দেখলেই লালায়িত হয়ে পড়ে তাঁদের সমাজে না-রেখে জঙ্গলে পাঠনোর ব্যবস্থা করা উচিত।”
মনোবিদ মোহিত রণদীপ পুলিশের ঔদ্ধত্যের কথাও বললেন। তাঁর মতে, “হেফাজতে যখন মৃত্যু ঘটে, তার পিছনে পুলিশের ঔদ্ধত্যের প্রকাশ থাকে। তারা যখন ধর্ষণ বা অন্য অপরাধ করে তাতেও প্রকাশ ঘটে সেই ঔদ্ধত্যেরই। পুলিশ জানে, তারা প্রশাসনের অঙ্গ। তাই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই প্রশাসনও কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যায়। সেই অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয় বহু ক্ষেত্রে। এটাও বাড়তি সাহস জোগায় পুলিশকে।”
নয়ডার ঘটনাটি ক্ষণিকের ইচ্ছায় ঘটেনি। বরং রীতিমতো ছক কষেই চড়াও হয়েছিল ধর্ষকেরা। মোহিতবাবুর বিশ্লেষণ, “অপরাধ করার ক্ষেত্রে পুলিশের একটা বাড়তি আত্মবিশ্বাস কাজ করে। একে তো তারা আইনটা অন্যদের চেয়ে বেশি জানে। তার ওপর, তারা মনে করে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগসাজশের জোরে তারা আইনের হাত গলে ঠিক বেরিয়ে যাবে।”
একই মত নারী আন্দোলন কর্মী শাশ্বতী ঘোষের। তাঁর বক্তব্য, “অপরাধ করলে তারাও রেহাই পাবে না শাস্তির মাধ্যমেই হোক বা অন্য ভাবে, প্রশাসন যদি এটা পুলিশকে বোঝাতে সক্ষম হয়, তবেই একমাত্র নয়ডা বা ফুলবাগান কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি কমতে পারে।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.