প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বাড়িছাড়া কান্দির এক আদিবাসী পরিবার। অভিযোগ, তাঁদের জমি ও বাড়ি জবরদখল করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র একদল প্রতিবেশী গত ২১ অগস্ট দিনভর পরিবারটিকে বাড়ির বাইরে যেতে দেয়নি বলে অভিযোগ। অবশেষে ওই দিন রাত দু’টো নাগাদ বৃষ্টি মাথায় করে অন্ধকারের মধ্যে তাঁরা গোপনে পালিয়ে আসেন কর্ণসুবর্ণে। প্রশাসনের সর্বস্তরে অভিযোগ করা সত্ত্বেও, এখনও অবধি ঘটনার কোনও তদন্ত হয়নি। মেলেনি সরকারের তরফে কোনও সহায়তাও।
কান্দি থানার কুমারষণ্ড গ্রামের আদিবাসী ওই পরিবারের প্রধান প্রৌঢ় সোম মাড্ডির অভিযোগ, “প্রাণ নিয়ে সপরিবারে পালিয়ে এসেছি। ঘরের মধ্যে ছিল ৩০ মন ধান, ৫০ কেজি চাল, ছেলের সাইকেল ও স্কুলের পোশাক, বোনঝির বই ও স্কুল ব্যাগ, কাঁসা-পিতলের থালা-বাসন। সবই লুঠ হয়ে গিয়েছে গত ২৪ অগস্ট রাতে। ছেলে সিবিজন ও বোনঝি ফুলকলির স্কুল যাওয়াও বন্ধ।” পরিবারটি রাতের অন্ধকারে পালিয়ে এসে প্রথমে আশ্রয় নেন কর্ণসুবর্ণ স্টেশনে। পরে আশ্রয় মিলেছে লাগোয়া সংস্কার গ্রামের দরজা-জানালাহীন একটি ঘরে।
সমস্যার সূত্রপাত জমি নিয়ে। সোমের অভিযোগ, সরকারি সহায়তার জন্য আবেদন করার নাম করে সাদা কাগজে তাঁকে দিয়ে টিপসই করিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর প্রতিবেশী তাজের আলি মিস্ত্রি, রেজাউল শেখ, হাসেন শেখ ও আনসার শেখ। সেই কাগজ ব্যবহার করে জমি বিক্রির দাবিতে তাঁরা জমি দখল করতে চায়। অভিযুক্ত প্রতিবেশীদের দাবি, ওই আদিবাসী পরিবারের ৪৮ শতক জমি তাঁরা কিনে নিয়েছেন।
তাজের আলি মিস্ত্রির স্ত্রী ময়না বিবি ও হাসেন শেখের ছেলে জিয়ারুদ্দিন শেখ বলেন, “কয়েক বছর আগে ওই জমি আমরা টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি। আদিবাসীদের জমি কেনা যায় না বলে লিজপত্র করেছি। এ সব বিষয়ে সব কিছুই জানেন পঞ্চায়েত প্রধান আইনাল হক।”
কংগ্রেসের দখলে থাকা কুমারষণ্ড গ্রাম পঞ্চায়েতের বিদায়ী প্রধান তথা বর্তমান প্রধানের স্বামী আইনাল হক অবশ্য সোম মাড্ডির বক্তব্যকেই সমর্থন করেন। তিনি বলেন, “আদিবাসীর জমি অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে হস্তান্তর করা যায় না। তবুও তাজের আলি মিস্ত্রি, রেজাউল শেখ, হাসেন শেখ ও আনসার শেখ ওই জমি কিনেছে দাবি করে জমি দখল করতে চায়।” পঞ্চায়েত প্রধান হিসাবে তিনি কেন ওই আদিবাসী পরিবারের পাশে দাঁড়াননি? আইনাল হকের জবাব, “তাজের, হাসেন, রেজাউলরা তৃণমূলের লোক। ওদের দাপটে আমারই নিরাপত্তা নেই!”
তৃণমূলের কান্দি ব্লক সভাপতি উজ্জ্বল মণ্ডল অবশ্য তাজের, হাসেনকেই সমর্থন করে বলেন, “তাজেররা নির্দোষ। ওরা তো টাকা দিয়েই জমিটা নিয়েছে সোম মাড্ডি আর তার ভাই রামচন্দ্র মাড্ডির কাছ থেকে।” উজ্জ্বলবাবুর দাবি, সোমের বোন সুনতি মাড্ডি মুসলিমকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। ফলে তিনি ওই জমির উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। কেন ধর্মান্তরিত হলে মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার হারাবে, তার ব্যাখ্যা অবশ্য মেলেনি তৃণমূলের এই নেতার কাছে।
বৃহস্পতিবার ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেল দিন দশেকের মধ্যে কোনও সরকারি কর্তাই ঘটনার তদন্ত করতে ওই গ্রামে পা রাখেননি। ওই গ্রামে একদা বেশ কয়েকটি আদিবাসী পরিবার থাকলেও এখন রয়েছে কেবল একটিই পরিবার সোম মাড্ডি। তাঁরাও এখন গ্রামছাড়া। তাঁদের বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্রও লুঠ হয়ে গিয়েছে।
সোম মাড্ডির দাবি, “থানায়, ব্লকে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে, জেলা দায়রা বিচারক ও পুলিশ সুপার-সহ বিভিন্ন দফতরে ওই প্রতিবেশীদের নামে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছি।” কিন্তু কান্দির ভারপ্রাপ্ত বিডিও অনির্বাণ বসু বলেন, “কয়েক দিন ধরে গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নির্বাচনে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। তবুও তার মধ্যেই সরজমিনে তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের ব্লক আধিকারিককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “আমার কাছে এখনও অভিযোগ পৌঁছয়নি। তবুও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কান্দি থানার আই সি-কে বলছি।” |