চাঁদ সদাগরকে, বাম হস্তে হইলেও, শেষ পর্যন্ত মনসার উদ্দেশে ফুল ছুড়িতে হইয়াছিল। শিল্পের চাহিদাগুলি স্বীকার করিয়া লইতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আন্তরিক অনীহা আছে বলিয়া বোধ হয় না। মুম্বইয়ের বণিক-সম্মেলনে তাঁহার ইতিবাচক মনোভাবের ঢের প্রশংসা হইয়াছে। ঘোষিত সময়সীমার সাত মাস পরে তিনি রাজ্যের বিনিয়োগ ও শিল্প নীতি প্রকাশ করিলেন। মুখ্যমন্ত্রী যে এই রাজ্যে বিনিয়োগের সমস্যাগুলি বুঝিতে আরম্ভ করিয়াছেন, তাহার কিছু ইঙ্গিত এই নীতিতে রহিয়াছে। তাঁহার সরকার, স্পষ্ট ভাবে বলিলে তিনি স্বয়ং, যে ভুলগুলি করিয়াছেন, কিয়দংশে সেই বিষয়েও পরোক্ষ স্বীকৃতি রহিয়াছে। বিলম্বে হইলেও, শিল্পের অপরিহার্যতা তিনি বুঝিয়াছেন। কিন্তু, তাঁহার ঘোষিত বিনিয়োগ নীতিতে ভঙ্গিটি চাঁদ সদাগরের। দায়ে পড়িয়া করিতেছেন বটে, কিন্তু মন নাই। কর-ছাড় আদি সুবিধা দেশের সব রাজ্যই শিল্পক্ষেত্রে দিয়া থাকে। অতএব, সেই ছাড়ের টানেই শিল্প আসিবে, এই প্রত্যাশা যথেষ্ট যুক্তিসংগত নহে। বকেয়া উৎসাহ ভাতার উপর বাজারের হারে সুদের প্রস্তাব কিঞ্চিৎ স্বতন্ত্র বটে, কিন্তু শিল্প টানিতে যথেষ্ট নহে।
শিল্প যাহা চহে, মুখ্যমন্ত্রী এত দিন তাহা দিতে সম্পূর্ণ নারাজ ছিলেন। এখন সম্ভবত মচকাইয়াছেন, ভাঙেন নাই। যে পদ্ধতিতে তিনি জমি-জট ছাড়াইতে প্রচেষ্ট হইয়াছেন, সেইটিই ইহার প্রমাণ। বেসরকারি উদ্যোগীর জন্য সূচ্যগ্র জমি জোগাড় না-করিবার জেদে তিনি অটল, কিন্তু জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত আইন পাশ কাটাইবার একটি ব্যবস্থা করিয়াছেন। আইনটি বিচিত্র রাজ্যের কোন অঞ্চলে সর্বাপেক্ষা বেশি কত জমি এক ব্যক্তি বা সংস্থার মালিকানায় থাকিতে পারে, তাহা এই আইনটির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। গোটা দেশে আর কোনও রাজ্যে এই আইন নাই। গোটা দুনিয়াতেই এমন তুঘলকি ব্যবস্থা বিরল। বৃহৎ শিল্পের জন্য যত জমি প্রয়োজন, তাহা কেনা এই আইনের কল্যাণে সম্ভব হয় না। মুখ্যমন্ত্রী জানাইয়াছেন, অতঃপর শিল্পসংস্থা বাড়তি জমির প্রয়োজনীয়তার কথা সরকারকে জানাইলে সরকার সেই জমি প্রথমে খাস করিয়া লইবে, ফের সংস্থাটিকে লিজ দিবে। ডায়মন্ড হারবার রানাঘাট ঘুরিয়া তিব্বতে পৌঁছাইবার এই চেষ্টা ছাড়িয়া মুখ্যমন্ত্রী একটি সহজ কাজ সারিয়া ফেলিলে সর্বমঙ্গলা বলিয়া বন্দিত হইবেন। জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত আইনটিকে অবিলম্বে রদ করিবার ব্যবস্থা করুন। বিধানসভায় নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা তাঁহার করতলগত, সূর্যকান্ত মিশ্ররা সায় না দিলেও অসুবিধা হইবে না। সংস্থাকে জমি কিনিতে বাজারে পাঠাইয়া ফের হাত বাঁধিয়া রাখিলে মুশকিল। বস্তুত, ইতিহাসের অভিশাপে এবং বামফ্রন্টের রাজনীতির কারণে পশ্চিমবঙ্গে জমির মালিকানা এমনই বহুখণ্ডিত ও বর্গা-কণ্টকিত যে, আইন বাতিল করিলেই সমস্যা মিটিবে না। সরকারকে অনেক ক্ষেত্রেই জমির ব্যবস্থা করিয়া দিতে হইবে।
শিল্পনীতির নিদান: কোনও সংস্থা শ্রমনিবিড় উৎপাদন পদ্ধতি গ্রহণ করিলে অপেক্ষাকৃত বেশি সরকারি সাহায্য পাইবে। দশ বৎসরে তিনি কত কর্মসংস্থান আশা করেন, তাহাও মুখ্যমন্ত্রী জানাইয়া দিয়াছেন। এই নীতি অযৌক্তিক ও ক্ষতিকর। কোন সংস্থা কত শ্রমিক নিয়োগ করিবে, সেই সিদ্ধান্ত একান্ত ভাবেই তাহার। এক কালে এই বিভ্রম বহুলপ্রচলিত ছিল, ‘যথোপযুক্ত প্রযুক্তি’র নামে শ্রমনিবিড় শিল্পের লালনপালন চলিত। শতাব্দী বদলাইয়া গিয়াছে। মমতাদেবীর একটি কথা বুঝিয়া লওয়া প্রয়োজন এক একটি ভুল সিদ্ধান্ত করিয়া দুই বৎসর পর তাহা সংশোধন করিবার মতো বিলাসিতার উপায় পশ্চিমবঙ্গের নাই। এই রাজ্য মৃতপ্রায়। ফলে, শিল্পনীতি লইয়া পরীক্ষানিরীক্ষার অবকাশ মুখ্যমন্ত্রীর নাই। যাহা করিবার, তাঁহাকে এখনই তাহা করিতে হইবে। শিল্পমহল মনসা নহে, বাম হস্তের পূজায় কাজ না-ও হইতে পারে। |