|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
বারুদের গন্ধটাই যা নেই |
যুদ্ধের সব মশলা হাজির। টানটান চিত্রনাট্য, নিখুঁত সম্পাদনা,
অসাধারণ ক্যামেরা। লিখছেন
সুমন দে। |
ম্যাড্রাস কাফে’র কৃতজ্ঞতা স্বীকারের টাইটেল কার্ডে অন্তত তাঁর নাম দেখতে পাব আশা করেছিলাম।
এপিজে আব্দুল কালাম।
শ্রীপেরুমবুদুরের ঘটনাস্থলে থেকে পাওয়া গিয়েছিল রাজীব গাঁধীর হত্যা মুহূর্তের দশটা স্টিল ফ্রেম। মাত্র তিন ফুট দূর থেকে লেন্সবন্দি করা। ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের হয়ে ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে মানববোমার রহস্যভেদে বিশেষ সাহায্য করেন কালাম, ভারতবর্ষের এগারোতম রাষ্ট্রপতি হওয়ার এগারো বছর আগে। যেহেতু এ ছবির মেরুদণ্ড বলুন বা ক্লাইম্যাক্স সবটাই ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নিধনকে ঘিরে, তাই এই ফিল্মের টাইটেল কার্ডের কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন বিশ্বখ্যাত তামিল বিজ্ঞানী।
পরিচালক সুজিত সরকার যতই ফিল্মের শুরুতে ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ মার্কা ডিসক্লেমার গুঁজে দিন, কয়েক সেকেন্ডেই পরিষ্কার হয়ে যায় ২৩ জুলাই ১৯৮৩-তে শুরু হওয়া শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ‘পছন্দসই’ শান্তি ফেরাতে ভারতের ভূমিকা, পররাষ্ট্রীয় কূটনীতি ও অনৈতিক রাজনীতি এ ছবির প্রেক্ষাপট নয়, একেবারে ঠাস বুনোটের অংশ।
ছবি শেষ হয় ১৯৯১-তে মানব বোমা বিস্ফোরণে ভারতের ‘প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী’-র মৃত্যুতে (রাজীব গাঁধীর নামটাই যা চিত্রনাট্যে লেখেননি সোমনাথ দে আর শুভেন্দু ভট্টাচার্য!)। এলটিটিই ছবিতে এলটিএফ ভিলুপিল্লাই প্রভাকরণ এখানে আন্না ভাস্করণ তবু কাউকে চিনতে অসুবিধে হয় না একটুও।
ছবির কাল্পনিক চরিত্র হাতে গোনা। তার মধ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্র জন আব্রাহাম অভিনীত বিক্রম সিংহ, প্রাক্তন সেনা অফিসার জাফনায় কভার্ট অপারেশনের জন্য র-প্রধান রবিন দত্ত (এই ভূমিকায় কু্ইজ মাস্টার সিদ্ধার্থ বসু দুর্দান্ত) নিজে যাঁকে নিযুক্ত করেছেন। আপামর ভারতবাসীর অনেকটাই জানা স্টোরি লাইনের এর বেশি উল্লেখ পরিচালকের পরিশ্রমের প্রতি অবিচার হবে। |
|
ম্যাড্রাস ক্যাফে
জন আব্রাহাম, নার্গিস ফাখরি |
রাজীব হত্যার দীর্ঘ সতেরো বছর পর তামিলনাড়ুর ফরেন্সিক সায়েন্স বিভাগের শীর্ষকর্তা আর চন্দ্রশেখরণ একটি অমূল্য বই প্রকাশ করেন‘দ্য ফার্স্ট হিউম্যান বম্ব’। তাতে দেখতে পাই ঘটনার পর কী হাস্যকর ভাবে তিন ভারতীয় এজেন্সিসিবিআই, আইবি এবং র পারস্পরিক দোষারোপে মেতেছিল।
সুজিতের ছবিতে বাস্তবসম্মত ভাবে উঠেছে সতর্কবার্তা ও নানা ইঙ্গিত থাকা সত্ত্বেও রাজনীতির ঘোলা জলে কী ভাবে পথ হারিয়েছিল ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা।
ডকু ফিচার হোক বা পিরিয়ড পিস, বলিউডের ছাঁচে পড়লেই তাতে যে অতিসরলীকৃত প্লট, অতিনাটকীয় চিত্রনাট্য, মেলোড্রামার মশলা আর সুস্পষ্ট ‘হিরো’ আর ভিলেন এসে পড়ে, সুজিতের এ ছবি সেই দোষ থেকে আগাগোড়া মুক্ত। কোনও পক্ষ না নিয়ে, এমনকী কোনও অবস্থানকে অকারণ ‘গ্লোরিফাই’ না করে মারকাটারি মুন্সিয়ানায় পরিচালক জাফনায় বাসে নৃশংস নাশকতার প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত দর্শককে টেনে রাখতে পেরেছেন।
পরিচালক সুজিত সরকারের এমন সাহসী ছবিতে টাকা ঢালার ঝুঁকি যিনি হাসিমুখে নিয়েছেন, গোটা ছবি জুড়ে, বিশেষত আবেগের দৃশ্যে, তাঁকে অভিনেতা হিসেবে ব্যবহার করে পরিচালকও কম ঝুঁকি নেননি। জন আব্রাহাম। শুধু মুখ্য অভিনেতা নন, এ ছবির প্রযোজকও তিনি। কোনও কোনও দৃশ্যে মার্কিন ‘অ্যাকশন’ ছবির ভাবলেশহীন নায়কদের মতো তাঁকে মানিয়ে গেলেও, বিশ্বাস করুন, বাকি সময়টা আপনি কল্পনা করতে বাধ্য হবেন এই রোলটি ইরফান খান, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, অভয় দেওল, মনোজ বাজপেয়ী বা নিদেনপক্ষে অজয় দেবগণ করলেও কী ভাবে উতরাতো! প্রযোজক জন পরিচালক সুজিতের যত বড় বন্ধু, অভিনেতা জন ছবির বেশির ভাগ সময়টা জুড়ে পরিচালকের তত বড় শত্রু।
‘লন্ডন-বেসড’ ওয়ার করেসপন্ডেন্ট’ জয়ার ভূমিকায় নার্গিস ফাখরি যথাযথ। তবে হিন্দি ডাবিংয়ের ঝামেলায় তাঁকে ফেলেননি সুজিত। আগাগোড়া অ্যাক্সেন্টেড ইংরেজিতেই আবদ্ধ রেখে। জন আব্রাহামের স্ত্রীর ভূমিকায় রাশি খন্নার অবশ্য চোখের জল ফেলা ছাড়া বিশেষ কিছু করার ছিল না। আন্নার ডান হাত মালায়ার ভূমিকায় অরিজিৎ দত্ত চমৎকার! তবে প্রতিটি দৃশ্যে মুগ্ধ করেছেন বেঙ্গালুরুর এক স্বল্প পরিচিত মঞ্চাভিনেতা। বালার ভূমিকায় প্রকাশ বেলাওয়াডি। বলিউডের অন্য পরিচালকেরা তাঁর বেঙ্গালুরুর বাড়ির সামনে লাইন লাগালেন বলে! কুর্নিশ জানাতে হচ্ছে চন্দ্রশেখর প্রজাপতির নির্মেদ সম্পাদনা ও কমলজিৎ নেগির ক্যামেরাকেও। আর এক বঙ্গসন্তান শান্তনু মৈত্রের আবহসঙ্গীত নিঃসন্দেহে সুজিতের ছবিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে পরিচালকের নিখুঁত মাত্রাবোধে আর একটি চির বিতর্ক সূক্ষ্ন ভাবে ছুঁয়ে যাওয়াকে তারিফ করতেই হচ্ছে। প্রশ্ন সাংবাদিকের কাছে নিজের সোর্স বা সংবাদ-সূত্র রক্ষা, নাকি রাষ্ট্র বা প্রশাসনের স্বার্থকোনটা বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত? যুগে যুগে গোটা পৃথিবীকে আলোড়িত করেছে এই বিতর্ক।
ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি (যার জেরে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়) ফাঁসের কারিগর দুই সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টাইনকে তাঁদের সংবাদসূত্র ( সেই বিখ্যাত ‘ডিপ থ্রোট’) গোপন রাখার অধিকারকে আদালত পর্যন্ত স্বীকৃতি দিয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, ইওরোপেও ‘কোটর্র্ অব হিউম্যান রাইটস’ ১৯৯৬-য়ের ‘গুডউইন বনাম ইউনাইটেড কিংডম’ মামলায় সূত্র রক্ষার অধিকারকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার অন্যতম মূল শর্ত মেনেছে। আন্তর্জাতিক আইনে তো বটেই, এমনকী আফ্রিকার মতো দেশের ‘কমিশন অন হিউম্যান রাইটস’-য়েও সাংবাদিকের সূত্র গোপনের অধিকার স্বীকৃত।
তবু এ দেশে, এ রাজ্যেও (নব্বই দশকের মাঝামাঝি উচ্চমাধ্যমিক প্রশ্ন ‘ফাঁস’-য়ের বিতর্ক অনেকেরই মনে থাকবে) এ প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়েছে। সুজিতের ছবির সাংবাদিক জয়া অবশ্য বারবার দৃঢ়তার সঙ্গেই এই বাউন্সার সামলেছেন। তদন্তকারী সংস্থা বা প্রশ্নকর্তার গায়ে যতই রাষ্ট্রীয় সিলমোহর থাক, জয়া সূত্রের পরিচয় ততটাই প্রকাশ্যে এনেছে, যতটা এবং যখন সে উচিত মনে করেছে। সাবাস সুজিত, এই সাবাসিটা সাংবাদিকতার পেশার তরফ থেকে।
১৯৯৮-তে মুক্তি পেয়েছিল সন্তোষ সিভানের ‘দ্য টেররিস্ট’ প্রায় একই বিষয় নিয়ে। সে বছর সদ্য স্মাতক এই প্রতিবেদক ছবিটা দেখতে গিয়েছিল মণিরত্নমের সিনেমাটোগ্রাফারের ফিল্ম দেখবে বলে। দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। |
|
‘ম্যাড্রাস কাফে’ দেখে এসে আর এক বার ইন্টারনেটে ‘দ্য টেররিস্ট’ দেখে বুঝলাম তথ্য ও ইতিহাসকে ছাপিয়ে তাতে বড় হয়ে উঠেছে আবেগের নিষ্পেষণ আর ব্যক্তি-যন্ত্রণা। সুজিতের ছবি নির্মোহ তথ্যনির্ভরতা বা পক্ষপাতহীনতায় অনেক এগিয়ে। আর যদি অলিভার স্টোনের ফিল্মের প্রভাবের কথাই বলা হয়, সাহসী সুজিত কবেই বা তা অস্বীকার করেছেন?
শেষে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ আনতেই হচ্ছে। ‘ম্যাড্রাস কাফে’ নিয়ে লাগাতার আক্রমণ, বিতর্ক আর হাঙ্গামায় তিতিবিরক্ত সুজিত ঘরোয়া আড্ডায় একবার ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। ছ’বছরের টানা গবেষণা, চিত্রনাট্যের ঘষামাজা, বিপুল স্কেলে ব্যয়বহুল শু্যটিংয়ের পর এত ঝামেলা দেখে হতাশ পরিচালকের সিদ্ধান্ত ছিলেন, “অনেক হয়েছে। ডকুফিচার আর নয়। পরের বার ‘ভিকি ডোনার’-ই বানাব।”
কথাটা ফিরিয়ে নিক সুজিত সরকার। এ অনুরোধ বন্ধুর নয়, সাংবাদিকেরও নয়, ভারতীয় ছবির দর্শকের। ‘ব্লাড ডায়মন্ড’ বা ‘গ্রিন জোন’-য়ের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো স্বদেশি ওয়ার মুভি আরও পেতে হবে যে! |
|
|
|
|
|