জেলেই এক জনের দিকে জুতো হাতে তেড়ে গিয়েছিলেন। এ বার রুদ্ধদ্বার এজলাসে সাক্ষ্য দিতে এসে তিন ‘অপরাধী’কে দেখিয়ে দিলেন অভিযোগকারিণী।
ঘটনার প্রায় দেড় বছরের মাথায়, শুক্রবার থেকে শুরু হল কাটোয়া ধর্ষণ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ। গত বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি বর্ধমানের কেতুগ্রামে ছোট রেলে (এখন ব্রডগেজ) ডাকাতির সময়ে ১১ বছরের মেয়ের মাথায় বন্দুক ধরে তার মাকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ দিন সেই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মহিলা সাক্ষ্য দিতে এলেন। জানালেন, দুষ্কৃতীরা মেয়েকে ধর্ষণ করবে বলে হুমকি দেওয়াতেই তিনি ট্রেন থেকে নামতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এ দিন দুপুর ১টা নাগাদ কাটোয়া ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের রুদ্ধদ্বার এজলাসে অবশ্য মা একাই সাক্ষ্য দিতে ঢোকেন। পরনে নস্যি রঙের তাঁতের শাড়ি, মাথায় ঘোমটা। ভিতরে বিচারক সৈয়দ নেহাজ্জুদিন আজাদ ছাড়া ছিলেন সরকারি কৌঁসুলি কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়, সাত আসামি (অষ্টম জন, কেতুগ্রামের কায়েশ শেখকে পুলিশ আজও ধরতে পারেনি) ও তাঁদের আইনজীবীরা। |
আইনজীবীদের সূত্রেই খবর, দুপুর আড়াইটে নাগাদ বিচারক মহিলাকে বলেন: অভিযুক্তদের কাউকে চেনেন?
সাক্ষীর কাঠগড়া থেকে নেমে দাঁড়ান মহিলা। চারদিক এক বার দেখে নেন। কয়েক পা হেঁটে থমকে দাঁড়ান একটু। তা দেখে সরকারি আইনজীবী এগিয়ে আসেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কোনও কথা না বলে সোজা আসামির কাঠগড়ার সামনে গিয়ে পরপর তিন জনকে দেখিয়ে দেন তিনি।
বিচারক জানতে চান: আপনার সঙ্গে কে চরম অসভ্যতা করেছে?
প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই মহিলা ডান হাত তুলে রেজাউল মির্জা ওরফে বাবুকে দেখিয়ে দেন। গত বছর ১৬ জুন কাটোয়া উপ-সংশোধনাগারে শনাক্তকরণ প্যারেডে এই রেজাউলকে দেখেই তিনি জুতো হাতে তেড়ে যান। এ দিন কাঠগড়ায় থাকা নয়ন শেখ ও জামিনে মুক্ত ফরিদ শেখকেও তিনি বিচারকের সামনে চিনিয়ে দিয়েছেন।
প্রথমে ডাকাতি ও ধর্ষণের দু’টি আলাদা অভিযোগ দায়ের হলেও পরে দু’টি মামলাকে একত্র করে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে পাঠানো হয়। ঘটনার রাতে যাঁরা রেলডাকাতির অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, বীরভূমের আমোদপুর থেকে কাটোয়াগামী ছোট রেলের সেই চালক ও গার্ডকে দিয়েই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার কথা ছিল বৃহস্পতিবার। তাঁরা না আসায় তা হয়নি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এ দিন মহিলার মেয়েরও সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিন ঘণ্টা ধরে বিচারক অভিযোগকারিণীরই বক্তব্য শোনেন। তাতেই সময় চলে যায়। সরকারি আইনজীবী বলেন, “অভিযুক্তদের আইনজীবীদের জেরাও বাকি রয়েছে। সোমবার ফের শুনানি হবে।”
ঘটনার রাতেই অভিযোগকারিণী রেলপুলিশকে জানিয়েছিলেন, পাঁচুন্দি ও অম্বল গ্রামের স্টেশনের মাঝে ট্রেন থামিয়ে ডাকাতি হচ্ছিল। তিনি সোনার দুল লুকিয়ে ফেললেও দুষ্কৃতীরা তাঁর ইমিটেশন হার কেড়ে নেয়। পরে ট্রেন থেকে নামিয়ে পাশের ঝোপে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। অভিযুক্তদের এক আইনজীবী বলেন, “উনি আদালতকে জানিয়েছেন, ধর্ষিত হওয়ার পরে তিনি কোনও রকমে ট্রেনে উঠছিলেন। সে সময়ে আরও এক দুষ্কৃতী তাঁকে টেনে নীচে নামানোর চেষ্টা করছিল। তখন দু’এক জন বলে ওঠে, ‘এ বার মরে যাবে, ছেড়ে দে।’ তার পর দুষ্কৃতীরা পালিয়ে যায়।” |
রেজাউল মির্জা ও নয়ন শেখের আইনজীবী ধীরেন বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেন, “আদালতে নতুন গল্প ফাঁদছেন মহিলা। সোমবার জেরার পরেই তা বোঝা যাবে।” রেজাউল আদতে মুর্শিদাবাদের বড়ঞা থানার কুলি চৌরাস্তার বাসিন্দা। পুলিশ সূত্রের খবর, এক আত্মীয়কে খুন করার পরে সে ওই জেলারই বড়ঞার বদুয়া গ্রামে মাসির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। এ দিন তার মা আদালতে দাঁড়িয়ে বলেন, “ও ছোট থেকেই মাসির বাড়িতে বড় হয়েছে। রং মিস্ত্রির কাজ করত। নয়ন ও ফরিদের কথা মতো পুলিশ ওকে ফাঁসিয়ে দিল।”
পুলিশ সূত্রের খবর, নয়ন এবং ফরিদও আদতে বড়ঞা থানারই কুলি অঞ্চলের কুমড়াই গ্রামের বাসিন্দা। সম্পর্কে তারা খুড়তুতো ভাই। ১৯৯৪ সালে বড়ঞায় দু’টি ও কেতুগ্রামে ৫টি খুনে অভিযুক্ত তারা। ফরিদ ও নয়নের তিনটি করে বিয়ে। ফরিদ আবার তার প্রথম স্ত্রীর খুনে অভিযুক্ত। বছর বারো আগে তারা বীরভূমের লাভপুর থানার চৌহাট্টা গ্রামের বিহারীপাড়ায় আস্তানা গাড়ে। গরুর পাইকারি ও ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে গোপনে ‘দুষ্প্রাপ্য মুদ্রা’ কেনাবেচার নামে লোক ঠকাতো তারা। চৌহাট্টা থেকেই পুলিশ তাদের ধরে। ফরিদ অবশ্য জামিনে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে। এ দিন আদালত থেকে বেরিয়ে সে দাবি করে, “এখন আমরা ২৮ জন মিলে লাভপুর পঞ্চায়েত সমিতি ও কাটোয়া-আমোদপুর লাইনে ঠিকাদারি কাজ করছি।” গোটা সাক্ষ্যের সময়টা পাশের ঘরে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে ঠায় বসেছিল মহিলার মেয়ে। পরে যখন আদালত চত্বর দিয়ে রেজাউলদের জেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, মেয়ে এসে মা-কে জড়িয়ে ধরে বলে, “সব ঠিকঠাক বলেছ তো? ভয় পাওনি তো?” মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলেন, “সব বলেছি রে!”
|