ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহল হস্তান্তর লইয়া সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে বিষাইয়া তুলিতেছে। এই ‘হস্তান্তর’ কার্যত ১৯৭৪ সালে দুই দেশের রাষ্ট্রনায়ক মুজিবর রহমান ও ইন্দিরা গাঁধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিরই সম্প্রসারণ। মনমোহন সিংহ তাঁহার বাংলাদেশ সফরকালে চার দশক আগের প্রতিশ্রুতি পালনেরই অঙ্গীকার করিয়া আসেন। এখন বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস এবং অসম গণপরিষদ সংসদে সেই চুক্তির রূপায়ণ সংক্রান্ত বিল পেশে বাধা দিতেছে। এই বাধাদানের পিছনে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির কায়েমি স্বার্থ ব্যতীত আর কিছু নাই। ছিটমহলগুলি হস্তান্তরিত না হইলে সেখানকার বাসিন্দাদের স্বার্থই সর্বাধিক বিপন্ন হইবে। তাঁহারা না পাইবেন কোনও দেশের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার, না উন্নয়নের দাবি জানাইবার অধিকার। সীমান্ত লইয়া প্রতিবেশী দুই মিত্ররাষ্ট্রের দ্বন্দ্বও অমীমাংসিত থাকিয়া যাইবে। সীমান্তে নিরাপত্তার সমস্যারও নিরসন হইবে না।
বিলম্বিত বোধোদয়ে বিরোধী দল বিজেপি সংসদে সংশ্লিষ্ট বিল পেশে বাধা না দিবার সিদ্ধান্ত লইলেও তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধিতার সিদ্ধান্তে অবিচল। দলীয় নেতৃত্বের বক্তব্য, তাঁহাদের ‘অজ্ঞাতসারে’ কেন্দ্র বাংলাদেশকে এই ছিটমহল হস্তান্তর করিতেছে। ইহা যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবিন্যাসের পরিপন্থী। প্রথমত, তথ্য হিসাবে ইহা ঠিক নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হইবার তিন মাস পর, ২০১১ সালের ১৫ অগস্ট তাঁহার মুখ্যসচিব কেন্দ্রীয় বিদেশ সচিবের চিঠির জবাবে ছিটমহল হস্তান্তরে রাজ্যের সম্মতি জানাইয়া দেন। আজ কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার ও কংগ্রেসের সহিত মধুচন্দ্রিমা টুটিয়া যাওয়ায় সেই তথ্য অস্বীকার করা কিংবা তাহাকে ‘রাজনৈতিক অনুমোদন-বর্জিত আমলা স্তরের পদক্ষেপ’ বলিয়া সাফাই গাওয়া দায়িত্বশীল শাসক দলের কাছে প্রত্যাশিত নয়। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রীয়তার নীতি শিরোধার্য করিয়াও প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনের কূটনৈতিক দায় কোনও দায়িত্বশীল দেশ এড়াইতে পারে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সহিত সুসম্পর্ক কার্যত এই চুক্তি এবং তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির রূপায়ণের উপর নির্ভরশীল। জল-চুক্তির ক্ষেত্রেও মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের স্বার্থরক্ষার নামে বাধা দিতেছেন। রাজ্যবাসীর স্বার্থ নিশ্চয় দেখা দরকার, কিন্তু যে নদী একাধিক দেশের উপর দিয়া প্রবাহিত, একটি অঙ্গরাজ্যের কৃষির প্রয়োজনে তাহার স্রোতোধারাকে বাঁধ দিয়া দেশের ভিতর আটকাইয়া রাখা আন্তর্জাতিক আইনেই অপরাধ। দলীয় রাজনীতি ভাল জিনিস, প্রাদেশিক স্বার্থরক্ষাও ভাল, কিন্তু প্রাদেশিক কূপমণ্ডূকতার রাজনীতি উত্তরণের দিশা নয়।
অথচ পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলনেতারা অনুগামীদের প্রাদেশিক আবেগ উসকাইতে কত হাজার একর জমি হস্তান্তরিত করিতে হইবে এবং বিনিময়ে কত স্বল্প-পরিমাণ জমি পাওয়া যাইবে, তাহার হিসাব দাখিল করিতেছেন। বাস্তবে বিষয়টি আদৌ তেমন নয়। যে-জমি হস্তান্তরের কথা হইতেছে, তাহার উপর এমনিতেও রাজ্যের বা দেশের নিয়ন্ত্রণ নাই, সেখানকার বাসিন্দারাও ভারতের নাগরিক নহেন। হস্তান্তর আইনসম্মত হইলে ছিটমহলের বাসিন্দারা যেমন বৈধ নাগরিকত্ব পাইবেন, উন্নয়নের অন্যান্য সুযোগসুবিধাও তাঁহাদের আয়ত্ত হইতে পারিবে। এই গুরুতর বিষয়টি উপলব্ধি না করিয়া ‘জমি চলিয়া গেল’ রব তুলিয়া রাজ্যের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের ষড়যন্ত্র খুঁজিবার হাস্যকর প্রয়াস বন্ধ হউক। ছিটমহল ও তিস্তার জল সংক্রান্ত বিরোধ মিটিয়া গেলে বাংলাদেশের সহিত ভারতের সম্পর্কই আরও নিবিড় হইবে, সে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা কিয়দংশে কমিবে, যাহাতে ভারতের লাভ, পশ্চিমবঙ্গের লাভ আরও বেশি। ভৌগোলিক সংলগ্নতার জন্য বাংলাদেশের যে কোনও অস্থিতির প্রভাব যে ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ভাগেই সর্বাধিক, সেই মৌলিক কথাটি ভুলিয়া গেলে চলিবে কি? |