সঙ্কটে ‘সমাজবাড়ি’
ঐতিহ্যের পুরাকীর্তি বাঁচাতে সরব কালনার বাসিন্দারা
শ্চিমবঙ্গের আরও একটি অসংরক্ষিত পুরাকীর্তি ধ্বংসের পথে। বর্ধমানের কালনা শহরে বর্ধমান রাজপরিবারের ‘পুরনো সমাজবাড়ি’ দীর্ঘ দিনের অবহেলায় বিপন্ন হয়েই ছিল, এ বার সেখানে একটি বেসরকারি কলেজ ও একটি লজ তৈরির উদ্যোগ শুরু হয়েছে। পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ কালনা-র এই বিশিষ্ট স্মারকটি ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনায় স্থানীয় ইতিহাস সচেতন মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। বর্ধমানের মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদ মহতাব জানিয়েছেন, তাঁরাও চান এটি সংরক্ষিত হোক।
বাংলার সুলতানি আমল থেকেই বাণিজ্যকেন্দ্র ও প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে ভাগীরথী তীরবর্তী কালনা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বৈষ্ণব কেন্দ্র হিসেবেও এর খ্যাতি কম নয়। মারাঠা বর্গিদের আক্রমণের আগে পর্যন্ত (১৭৪২) কাটোয়ার কাছে দাঁইহাটে ছিল বর্ধমান রাজপরিবারের গঙ্গাতীরে বসবাসের প্রাসাদ। বর্গি হানায় দাঁইহাট ক্ষতিগ্রস্ত হলে রাজারা কালনায় গঙ্গাবাস, রাজপ্রাসাদ, সমাজবাড়ি, গঙ্গার ঘাট, আর বহু মন্দির তৈরি করান, তাঁদের আনুকূল্যেই কালনা পুনরুজ্জীবিত হয়। বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সংরক্ষিত বিশাল আয়তনের বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলীর অনেকগুলি মন্দির কালনার পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু এরই পাশাপাশি রাজপরিবারের ‘সমাজবাড়ি’ থেকে গিয়েছে ব্যক্তিগত মালিকানায়, চূড়ান্ত অবহেলিত অবস্থায়।
কমলকুমারীর স্মৃতি মন্দির। রাজপরিবারের হাত থেকে এখন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন।— নিজস্ব চিত্র।
পশ্চিম ভারতীয় রীতি অনুযায়ী, সৎকারের পর পাথর বা ধাতুর পাত্রে চিতাভস্ম সহ মৃতের কিছু প্রিয় জিনিস রেখে তার উপর স্মৃতিমন্দির তৈরি করা হয়, একেই বলে ‘সমাজবাড়ি’। দাঁইহাটে কীর্তিচাঁদের (মৃত্যু ১৭৪০) সমাজবাড়ি আছে। কালনায় গঙ্গার ধারে ১৮৩৩-এ বর্ধমানের রাজা মহতাবচাঁদ ১ একর ৪৩ শতক জমির উপর পুরনো সমাজবাড়ি তৈরি করেন। পাঁচিলঘেরা এলাকায় রয়েছে দু’টি স্মৃতিমন্দির তেজচাঁদ (মৃত্যু ১৮৩২) ও তাঁর স্ত্রী কমলকুমারীর (মৃত্যু ১৮৬১)। প্রথমটি বিরল রীতির স্থাপত্য-- সতেরো চূড়া মন্দির, দ্বিতীয়টি নবরত্ন বা নটি চূড়ার মন্দির। পরে আর একটি নতুন সমাজবাড়িতে মহতাবচাঁদ, আফতাবচাঁদ ও তাঁদের স্ত্রীদের সমাজ রক্ষিত হয়, সেটি এখন কালনা মহিষমর্দিনী স্কুল। বিজয়চাঁদ ও উদয়চাঁদ মহতাবের সমাজবাড়ি আছে বর্ধমান শহরে, বিজয়ানন্দ বিহারে। দাঁইহাটের সমাজবাড়ি ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের সংরক্ষিত পুরাকীর্তির মর্যাদা পেয়েছে, কিন্তু কালনা-র সে সৌভাগ্য হয়নি। অথচ এমন পুরাকীর্তি সারা রাজ্যেই বিরল।
১৯৬৬-র ২৮ জানুয়ারি বর্ধমান রাজ এস্টেট থেকে দীর্ঘমেয়াদি লিজে সমাজবাড়ির দেখভালের দায়িত্ব পান নবদ্বীপের তেঘড়িপাড়ার বাসিন্দা অবনী বিশ্বাস। দায়িত্ব পাওয়ার পর বর্ধমান রাজ এস্টেটে কর দিতেন বিশ্বাসরা। পরে তাঁরা সরকারের কাছে সমাজবাড়ি নিজেদের দায়িত্বে নেওয়ার আবেদন জানান। সেই আবেদন মঞ্জুর হয়। পুরসভার নথিতে ডাঙাপাড়া হোল্ডিং-১, খতিয়ান নম্বর ৫৭৯৩, এল আর নম্বর ১২৯০২/১ হিসেবে চিহ্নিত সমাজবাড়ি। কিন্তু সমস্যা দেখা যায় ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের নথিতে। সেখানে এই বাড়িটিকে ‘সমাধিস্থল’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনও সমাধিস্থলের অধিকার কোনও ব্যক্তিকে দেওয়া সম্ভব নয়। এর পর সমাজবাড়ির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিশ্বাসরা আদালতে যান।
কালনা মহকুমা আদালতের আইনজীবী মলয় পাঁজা জানান, ২০১১-য় বিশ্বাস পরিবার সিভিল জজ জুনিয়র ডিভিশনের আদালতে মামলা দায়ের করে। আদালতের রায় ওই পরিবারের পক্ষে যায়। সমাজবাড়ির উপর বিশ্বাসদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কালনাবাসী সমাজবাড়ির এক শরিকের কথায়, “পুরো বাড়ি সংস্কার করতে খরচ প্রচুর। কিছু জায়গা বেদখলও হয়ে গিয়েছে। আমাদের পক্ষে সম্পত্তি রক্ষা করা সম্ভব নয়।” তাই বিশ্বাস পরিবারের শরিকেরা তাঁদের ভাগের জায়গা বিক্রি করেন শহরের ব্যবসায়ী সুব্রত পালকে।
ঐতিহ্যশালী সমাজবাড়ির ভবিষ্যৎ কী? সুব্রতবাবু বলেন, “ওখানে একটি কলেজ ও একটি লজ বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে মানুষের আবেগ জড়িয়ে থাকায় সমাজবাড়ির ভিতরের মন্দির সংস্কার করা হবে। গোটা প্রকল্পটির জন্য খরচ হবে ১৬ লক্ষ টাকা।” সমাজবাড়ি চত্বরে রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আবগারি দফতরের কালনা শাখা। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়টি তৈরি হয় ১৯৭৫-এ, আবগারি দফতরটি ১৯৮০ সালে। এ প্রসঙ্গে বাড়ির শরিকরা জানিয়েছেন, স্কুলকে স্বেচ্ছায় জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হবে। আবগারি বিভাগ ইতিমধ্যেই অন্য জায়গায় কাজ শুরু করেছে।
২০১১-য় সমাজবাড়ি নিয়ে এলাকায় আলোচনা শুরু হলে নড়েচড়ে বসেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কয়েকটি সংগঠন প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করে। সম্প্রতি সমাজবাড়ির পাঁচিল ভাঙার সময় শ্রমিকরা স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভের মুখে পড়েন। সমাজবাড়ি রক্ষার দাবিতে এলাকায় মিছিল করেছে তৃণমূল। বিশ্বাস পরিবারের দাবি, প্রশাসনের সঙ্গে তাঁদের কয়েকটি বৈঠক হয়। মহকুমা শাসকের কার্যালয়ে এক বৈঠকে সম্পত্তি সরকারি দরে কিনে নেওয়ার আবেদন জানানো হয়। একই আবেদন জানানো হয় কালনা পুরসভাকে। কিন্তু প্রশাসন উদ্যোগী হয়নি। এর পর কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সমাজবাড়ি বিক্রির চিন্তাও করা হয়। দু’টি সংস্থা এই বিষয়ে উৎসাহ দেখালেও পরে আর যোগাযোগ করেনি।
সমাজবাড়ি সংরক্ষিত ঐতিহ্যের তালিকায় এলে শহরের পর্যটন-মানচিত্রে যোগ হত আরও একটি নতুন নাম। কিন্তু সরকারি তরফে কোনও ব্যবস্থা হল না কেন? কালনার বিধায়ক তথা পুরসভার চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ কুন্ডুু জানান, বছর দেড়েক আগে রাজ্যের তৎকালীন পর্যটনমন্ত্রী রচপাল সিংহকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। বর্তমান পর্যটনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীকেও এটি জানানো হয়েছে। “কিন্তু আমাদের উদ্যোগে কোনও ইতিবাচক ফল মেলেনি।”
কালনা মহকুমা ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব চর্চা কেন্দ্র, বর্ধমান জেলা পুরাতত্ত্ব চর্চা কেন্দ্র, বর্ধমান ইতিহাস সন্ধান প্রভৃতি নানা ইতিহাসপ্রেমী সংগঠন এ ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপের দাবিতে সরব হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের তরফে রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উপ-অধিকর্তা অমল রায় জানান, কালনা পুরসভা এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠালে কমিশন অবশ্যই তা বিবেচনা করবে।

নতুন মালিকের বাড়িতে বোমা
সমাজবাড়ি কিনে নেওয়ার পর থেকেই ফোনে হুমকি পাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ বাড়িটির বর্তমান মালিক সুব্রত পালের। বৃহস্পতিবার ভোরে কালনা নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তাঁর বাড়িতে দুষ্কৃতীরা বোমা ছোড়ে বলে অভিযোগ। বাড়ির পাহারাদার নৃপেন সাহা জানান, বাড়ির সামনে একটি সকেট বোমা ছোড়া হয়েছিল। তাতে বাড়ির নীচের অংশে ক্ষতি হয়েছে। বিকেলে শহরের পুরশ্রী মঞ্চে সমাজবাড়ি নিয়ে ডাকা সাংবাদিক বৈঠকে সুব্রতবাবু বলেন, “ব্যক্তিগত মালিকানায় ছিল বলেই সমাজবাড়ি কেনা গিয়েছে। রটানো হচ্ছে, বাড়িটি টুকরো টুকরো করে বিক্রি করা হবে। এ ধারণা ঠিক নয়। বাধা এলে সরে যাব।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.