আখির কিউ
সন্তে যে হাঁসের দল ঝাঁকে ঝাঁকে চলে হিমালয়ের দিকে, তারা যদি হঠাৎ পাতিহাঁস হয়ে গিয়ে পাড়াগাঁর এঁদো পুকুরে প্যাঁকপ্যাঁক করতে থাকে, তা হলে যে দেশটার জন্ম হয় তারই নাম ‘তাসের দেশ’। রীতিমতো পাসপোর্ট-টাসপোর্ট বানিয়ে যে দেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কিউ। রবীন্দ্রনাথের দেড়শো বছর। সুতরাং তাঁর লেখা থেকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সিনেমা হবে। স্বাভাবিক। সিনেমার নামে নানা নিরীক্ষামূলক ভাঙাগড়াও চলবে। কিন্তু তা বলে ঝাড়া একশো চোদ্দো মিনিট ধরে হুলতাল অর্থহীন কিউকীর্তি!
অথচ ইন্ডাস্ট্রিতে কিউকীর্তি-র যে নমুনাদু’টি এর আগে দেখেছি সেখানে পরিচালকের একটা গতিপথ বোঝা যাচ্ছিল। ‘লাভ ইন ইন্ডিয়া’ এবং ‘গান্ডু’ দু’টি সিনেমাই বুঝিয়ে দিয়েছিল নতুন কিছু বলতে এসেছেন কিউ। নিছক দু’চারটে বাজার গরম করা খোলামেলা সিন দিয়ে যৌনতার ছেলেমানুষি নয়, বড়দের মতো করে যৌনতাকে বুঝতে চাইছেন তিনি। যৌনতা তাঁর ছবিতে একটা চোরাস্রোতের মতো। কিন্তু কী আশ্চর্য! রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে ওই চোরাস্রোত আর চোরাবালিতেই টেনে নিল সম্ভাবনাময় পরিচালককে। নিজের থিসিসে রবীন্দ্রনাথকে ফেলে দেখতে গিয়ে ফজলি আম হয়ে উঠল আঁশফল। ধ্রুপদী সাহিত্যের বীজটুকু পরিচালকের চোখে পড়ে নতুন মাত্রা পেয়েছে, তৈরি হয়ে উঠেছে নতুন একটা সৃষ্টি এমন দৃষ্টান্ত অনেক দেখেছি আগে। কিন্তু ‘অ্যাডাপটেশন’ যে ধ্রুপদী সাহিত্যের ডানাফানা ছেঁটে ফেলে তাকে বন্দি করে ফেলতে পারে খুব ছোট্ট একটা খাঁচায় সেটা দেখালেন কিউ।
তাসের দেশ
ঋ, ইমাদ, অনুব্রত, জয়রাজ
খাঁচাটার নাম যৌনতা। ফ্যাসিবাদও। বস্তুত, এই দুটি ধারণার ফ্রেমে রবীন্দ্র সংলাপগুলিকে ছকবন্দি করেই সম্পূর্ণ হয়েছে ‘অ্যাডাপটেশন’। তাতে দোষ ছিল না। পরিচালক তাঁর নিজস্ব দর্শনের প্রকাশই তাঁর ছবির পর ছবিতে ঘটিয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু সেই ‘দর্শন’ কতটা দর্শন আর কতটা চটকদার উপস্থাপনমাত্র, সেটা বিচার করা জরুরি। বড় হওয়া মানে যে শুধু খোলামেলা যৌনতা নয়, ওড়বার অকারণ আনন্দ মানে যে শুধু সমকামী কিংবা বিষমকামী যৌনতার প্রকাশ নয়, বোঝা জরুরি সেটাও।
কিউ যে সেটা বুঝেছেন এমন কোনও প্রমাণ তাঁর ‘তাসের দেশ’-এ নেই। কয়েকটি আখ্যানের ইঙ্গিত এ ছবির বিস্তর ক্লান্তিকর হুটোপুটির মধ্যেও ছুঁয়েছিল। ভবঘুরে এক নাট্যপরিচালক কিংবা সাহিত্যিক (জয়রাজ) পথে আর প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়ায়, বসে থাকে। তার সঙ্গে সারা ক্ষণ থাকে ‘তাসের দেশ’-এর মঞ্চায়নের নির্দেশ-সহ খাতা। ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে আসে ভাঙা এক রাজবাড়িতে। সেখানে থাকে এক হরতনী। বিধবার বেশ তার। সাদা-কালোয় তার সঙ্গে প্রায় নির্বাক এক সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে ভবঘুরের। অবশ্য সম্পর্ক একটা ছিল। ছিল যে, সেটা বোঝা যায় সংলাপে, ‘হরতনী, তুমি এখানে!’ ছবির একেবারে শেষে ভাঙা রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে ‘স্বাধীন’ হরতনী, হেঁটে যায় ভবঘুরের সঙ্গে, রেললাইনের ওপর দিয়ে।
গল্পটা ভাল করে বলেননি কিউ। সে গল্পটার মধ্যে ঢুকে পড়েছে রাজপুত্র-সদাগরপুত্রের নতুন দেশের কাণ্ডকারখানা। সেখানেও আর এক হরতনী। শেষে যে হরতনী আক্ষরিকই মশাল ধরে হেঁটে যাবে মিছিল নিয়ে। স্বাধীনতার মিছিল? বিপ্লবের মিছিল? কে জানে! সংলাপগুলি আওড়ানো ছাড়া চরিত্ররা ঠিক কী করতে চায় বোঝা গেল না। পাথরের ছোট টিলা-ঘেরা অংশে সাগরের উচ্ছ্বাস এসে পড়ার দৃশ্যটি চমৎকার। কিন্তু তার ভিতরেও তাসবংশীয়রা হঠাৎ মুক্তিতে শুধু শরীরেই ঘনিষ্ঠ হন। মনের মুক্তি আর ঘটে না। ঠিক যেমন সব রকমের অর্থহীন নিয়মের বেড়া ভাঙার ডাক দেওয়ার বিস্তার আবারও একটা বেড়ার মধ্যে ঢুকে পড়ে নাৎসিবাহিনীর প্রতীকে। ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটা একান্ত ভাবে সেই দেশ-কালে বদ্ধ হয়ে পড়ে। স্ত্রীর পত্র-এর মৃণালও যে আর এক অর্থে হরতনী, মাখন বড়ালের গলিটাও যে একটা জ্যান্ত তাসের দেশ, সেই ভাবনা বিস্তারের আর কোনও জায়গাই থাকে না। আর দুই হরতনীর আখ্যানে যোদ্ধা মা-র উপরে অত্যাচার এবং তাঁর নির্বাসনের আরও এক আখ্যান-ইঙ্গিত জুড়ে বসে সব তালগোল পাকিয়ে দেয়।
একটা বাঁধা যুক্তি অবশ্য থাকতেই পারে পরিচালকের। ন্যারেটিভের চেনা গড়নটাই তো একটা ‘তাসের দেশ’। ঠিকই। সংলাপের অনর্থক প্রতিধ্বনি করে, ঝিনচ্যাক ছাড়া কিছু থাকবে না ছবির চলনকে দুমড়েমুচড়ে ভাঙাটা ভালই গেল। কিন্তু গড়া হল কি কিছু? বরং ন্যারেটিভ না ভাঙলে ‘আন্তর্জাতিক’ ছবি হয় না-জাতীয় অনড় নিয়মের একটা তাসের দেশেই ঢুকে পড়া হল না?
কিউ-এর গড়া সেই তাসের দেশ-এর স্বখাতে ডুবে মরেছে এ ছবির বেশ কয়েকটি নতুন ভাবনা। এক, শ্রীলঙ্কার অভিনেত্রীদের দিয়ে অভিনয় করানো। রাবীন্দ্রিক ললিতলবঙ্গলতায় জোর ধাক্কা ছিল এটা। দুই, ভারতীয় সাহিত্যের চিরন্তন টাইপ চরিত্র পত্রলেখাকে রহস্যময় এক ব্যঞ্জনা দেওয়া। তিন, অ্যাডাপটেশনেও রবীন্দ্রনাথের সংলাপ অবিকৃত রাখা। তিনটিই সাহসী সিদ্ধান্ত। কিন্তু ছবিটা শেষ পর্যন্ত কোথাও গিয়ে না দাঁড়ানোয় তিনটিই মাঠে মারা গিয়েছে।
হরতনীর ভূমিকায় ঋ অনবদ্য। কিন্তু ডিরেক্টর্স পাপেট তিনি। জয়রাজ স্বাভাবিক। অনুব্রত ছক-ভাঙা। নীল অধিকারী আর মিতি অধিকারী-র সঙ্গীত মনে রাখার মতো। দু’একটি মুহূর্তে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার মনে থাকবে। রবীন্দ্রসঙ্গীত, কিউ-এর তাসের দেশ-এ দখিনা বাতাসের মতো। নইলে পাসপোর্ট নিয়ে সে দেশে যাঁরা ঢুকবেন তাঁরা প্রায় সকলেই ‘হাইবংশীয়’ হয়ে উঠবেন, হলফ করে বলতে পারি। তবে সেটা বোধহয় সচেতন ভাবেই করা। দর্শকদের ধরে ধরে শক থেরাপি দেওয়ার মতো এ আসলে পরিচালকের ‘হাই-থেরাপি’!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.