সরকারের কাছে আশঙ্কাটা আগেই জানিয়েছিলেন অর্থ মন্ত্রকের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদরা। খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের জন্য চলতি অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম বরাদ্দ করছেন ৯০ হাজার কোটি টাকা। অথচ অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য, অঙ্কের সোজা হিসেবেই দেখা যাচ্ছে, ২০১৩-’১৪ অর্থবর্ষে শুধু খাদ্যশস্য কিনতেই খরচ হয়ে যাবে ১ লক্ষ ২৪ হাজার কোটি টাকা। তার পরে রয়েছে প্রকল্প চালানোর নানা আনুষঙ্গিক খরচ।
কিন্তু অর্থনীতির সব যুক্তিই হার মেনেছে রাজনীতির কাছে। এত দিন যা ছিল অর্থ মন্ত্রকের অন্দরমহলের গুঞ্জন, এখন সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে শেয়ার বাজারের হট্টগোল। খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের জেরে রাজকোষ ঘাটতি বেড়ে যেতে পারে বলে লগ্নিকারীদের আশঙ্কায় পড়তে শুরু করেছে শেয়ার বাজার। যে আশঙ্কায় টাকার পতনও গতি পেয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের যুক্তিটা স্পষ্ট। সরকারি হিসেবে শুধু খাদ্যশস্যের খরচই ধরা হচ্ছে। কিন্তু সস্তায় খাবারকে আইনি অধিকারের মর্যাদা দিতে গেলে শুধু খাদ্যশস্যের জোগানেই সরকারের দায় শেষ হবে না। নতুন কর্মী-অফিসার নিয়োগ করতে হবে। রাজ্যে রাজ্যে খাদ্য কমিশন তৈরি করতে হবে। আমজনতার অভিযোগ এলে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নতুন দফতর খুলতে হবে। কারা সস্তায় খাবারের সুবিধা পাবেন, তার তালিকা তৈরি করতে হবে। খাদ্য ও গণবন্টন নিগমের পরিকাঠামোও মজবুত করতে হবে। এর সঙ্গে যোগ হবে পরিবহণের খরচ। এমন অনেক খরচের হিসেব আগাম কষাই সম্ভব হয়নি। শুধু খাদ্যশস্যের খরচ ধরলেও প্রতি বছর তা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই খরচের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারের আয় না বাড়লে, রাজকোষ ঘাটতি বৃদ্ধি পেতে বাধ্য।
অর্থ মন্ত্রকের অনেক কর্তাই তাই মনে করছেন, লগ্নিকারীদের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তা পুরোপুরি অমূলক নয়। চিদম্বরম বলছেন, চলতি অর্থবর্ষে খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প কার্যকর করার জন্য বাড়তি ব্যয় হবে মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে রাজকোষ ঘাটতি লাগামছাড়া হওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু অর্থ মন্ত্রক সূত্র বলছে, প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী, ২০১৩-’১৪ অর্থবর্ষে খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের জন্য ৬ কোটি ১২ লক্ষ টন খাদ্যশস্য প্রয়োজন হবে। শুধু এর জন্যই খরচ হবে ১ লক্ষ ২৪ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবর্ষে খাদ্যে ভর্তুকি বাবদ যা খরচ হওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে শুধু এখানেই খরচটা ২৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। এ বার তার সঙ্গে যদি অভিযোগ নিরসনের ব্যবস্থা, খাদ্যশস্য পরিবহণের খরচ, গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মায়েদের জন্য নগদ ভাতার খরচ ধরা হয়, তা হলে? চিদম্বরমের মন্ত্রকের অর্থনীতিবিদরাই মনে করছেন, সে ক্ষেত্রে খাদ্যে ভর্তুকির খরচের তুলনায় অতিরিক্ত ৪৪ হাজার কোটি টাকার দরকার হবে। পরের বছরগুলিতে এই খরচ আরও বাড়বে।
২০১৪-’১৫ অর্থবর্ষে বাড়তি ব্যয় হবে ৪৭ হাজার কোটি টাকা।
তার পরের বছর, ২০১৫-’১৬-তে বাড়তি খরচের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। কাজেই খাদ্য সুরক্ষা আইনের জন্য বাড়তি খরচ আসলে খুবই কম এই যুক্তি ধোপে টিকছে না।
চিদম্বরমের প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা তথা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরবর্তী গভর্নর রঘুরাম রাজনের দফতরের অর্থনীতিবিদ প্রাচী মিশ্রর মতো অনেকেই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে নিজেদের মত জানিয়েছেন। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, প্রাচী জানিয়েছেন, খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের যে খরচ বলা হচ্ছে, তা আসলে ন্যূনতম কত ব্যয় হবে, তার হিসেব। কার্যক্ষেত্রে খরচ আরও বেশি হবে। সরকারি নীতিতে ফাঁকফোকর থাকায় প্রতি বছর কৃষকদের থেকে প্রয়োজনের তুলনায় গড়ে ৪০ শতাংশ বেশি খাদ্যশস্য কেনা হয়। ফলে খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রেও যা হিসেব ধরা হয়েছে, তার চেয়ে ব্যয় বেশি হয়। যদি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাড়ানো হয়, তা হলেও খাদ্যশস্য কেনার খরচ বাড়বে। বণ্টন ব্যবস্থা তৈরির জন্যও নতুন খরচ হবে। সব মিলিয়ে বাড়তি খরচের পরিমাণ ২০১৩-’১৪ সালেই প্রায় ৮১ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকবে। যা দেশের জাতীয় আয়ের ০.৭ শতাংশ।
চিদম্বরম যুক্তি দিচ্ছেন, এখনই একইসঙ্গে গোটা দেশে এই ব্যবস্থা চালু হচ্ছে না। রাজ্যগুলিকে উপভোক্তার তালিকা তৈরির পর প্রকল্প শুরুর জন্য এক বছর সময় দেওয়া হয়েছে। কাজেই চলতি বছরের জন্য বাজেটে বরাদ্দ হওয়া অর্থ যথেষ্ট। চিদম্বরম লক্ষ্য স্থির করেছেন, রাজকোষ ঘাটতিকে তিনি জাতীয় আয়ের ৪.৮ শতাংশে বেঁধে রাখবেন। এমনকী ঘাটতি আরও কম হতে পারে বলেও তাঁর আশা। চিদম্বরমের এই আশা পূরণ হয়, নাকি অর্থনীতিবিদ ও লগ্নিকারীদের আশঙ্কাই সত্যি হয়, সেটাই দেখার। |