পাড়ায় তারা ‘জোড়া ভীম’! এক জনের ওজন ১৪৫ কিলো, অন্য জনের ১১৫! প্রথম জন কুড়িতে পা দিয়েছেন, দ্বিতীয় জন এখনও কৈশোরে। বয়স মাত্র চোদ্দো, ক্লাস সেভেনে পড়ে সে।
যত দিন যাচ্ছে, দুই সহোদরের ওজন বেড়েই চলেছে! এমন বিপুলায়তন শরীর নিয়ে তাদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। শোয়ার খাটে জায়গা হয় না। একটু হাঁটাচলা করলেই হাঁফ ধরে যায়। স্কুলে বসার বেঞ্চ ছোট। বাড়িতে চেয়ারে বসতে গেলে ভেঙে যাচ্ছে। দুই ভাইয়ের শরীরের মাপের জামাকাপড় পাওয়াই এখন দুষ্কর হয়ে উঠেছে।
বড় জন অটোরিকশা চালাতেন। ওজনের জন্য এখন অটোয় ঢুকতেই পারেন না। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা-মা দিশাহারা দু’জনের খাবারের জোগান দিতে। কিলো-কিলো ভাত-ডাল-তরকারি নিমেষে উড়ে যায়, তা-ও দুই ভাইয়ের বারংবার খিদে পায়। উপায় খুঁজে না-পেয়ে শেষ পর্যন্ত কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাশাপাশি শয্যায় ভর্তি করা হয়েছে দু’জনকে। কী ভাবে দু’জনকে রোগা করা যায়, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। কিন্তু তাঁদের মাত্রাছাড়া ওজনের মূল কারণটা এখনও হাতড়াচ্ছেন হাসপাতালের এন্ডোক্রিনোলজির চিকিত্সকেরা। |
বড় ভাইয়ের নাম কিষেণ মণ্ডল, ছোট সুজিত। বাড়ি রাজারহাটের পাথরঘাটা পঞ্চায়েতের আনন্দকেশরী অঞ্চলে। চিকিত্সকদের মতে, বয়স ও উচ্চতার নিরিখে বড়টির স্বাভাবিক ওজন হওয়ার কথা ৬৫, ছোটর ৫৫ কেজি। দু’জনকে দেখে অনেকেরই মুর্শিদাবাদের ‘অতিকায় শিশু’ লোকমান হাকিম মণ্ডলকে মনে পড়েছে। ১১ মাসের সেই শিশু দিনে আড়াই কিলো ভাত এবং পাঁচ লিটার দুধ খেত। তার ওজন ছিল ২০ কেজি। শ্বাসনালীতে খাবার আটকেই শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছিল সে।
কিষেণ আর সুজিতের খাদ্য-তালিকায় অবশ্য বিপুল ভাত-রুটি-ডাল-তরকারির সঙ্গে মুঠো-মুঠো খাজা, গাঠিয়া, চানাচুর-সিঙাড়া-ভাজাভুজিও রয়েছে। দুই ছেলের বাবা প্রবীর মণ্ডলের কথায়, “এক বার পেট ভরে খাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে ওদের খিদে পেয়ে যায়। আমরা গরিব মানুষ। এত খাবার জোটাব কী করে? ভেলোরে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওঁরাও বিশেষ কিছু করতে পারেননি।”
মেডিক্যালের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের চিকিত্সকদের দাবি, ওজন বাড়ার সমস্যা নিয়ে অনেক অল্পবয়স্ক আসে। কিন্তু দুই সহোদর ভাইয়ের এমন বিপুল ওজন বিরল। বিভাগীয় প্রধান আশিস বসু জানিয়েছেন, এদের বংশে ‘ওবেসিটি’র কোনও ইতিহাস নেই। রক্তপরীক্ষায় থাইরয়েডও পাওয়া যায়নি। কিন্তু দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে মেদ জমেছে। তাঁর কথায়, “এটা হাইপোথ্যালামাস নিয়ন্ত্রিত ওবেসিটি। মস্তিষ্কের একটা অংশ হল হাইপোথ্যালামাস। খিদে পাওয়ার অনুভূতি সেখান থেকে আসে। আবার পেট ভরে গেলে তার খবর পৌঁছে যায় ওখানে। হাইপোথ্যালামাস ঠিকঠাক কাজ না করলে পেট থেকে সেই বার্তা ঠিকমতো মস্তিষ্কে আসে না। ফলে পেট ভর্তি থাকলেও মানুষ খেতে থাকে। এদের সম্ভবত সেটাই হয়েছে।” জিনগত কোনও ত্রুটিতে এটা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য দু’জনের ক্রোমোজোম পরীক্ষাও হবে।
হাসপাতালের শয্যায় গেঞ্জি-বারমুডা পরে বসে ছিল দুই ভাই। দু’জনের গায়ের চামড়াই শক্ত হয়ে কুঁচকে গিয়েছে। কিষেণ বলল, “আমি ভীষণ রোগা হতে চাই। ডাক্তারবাবু যা বলবেন, তা-ই করব। আমি অটো চালাতে পারছি না, হাঁটাচলা করতে পারছি না। আমার নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয়, বুকে ব্যথা করে, পায়েও খুব ব্যথা। ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে।” আর সুজিত বলল, “আমি স্কুলে যেতে পারি না। বন্ধুরা খ্যাপায়। খেলতে পারি না। আমি রোগা হব।” ভারতে এখন মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ ‘ওবেসিটি’-তে ভুগছে। মোটা মানুষের সংখ্যায় পঞ্জাব প্রথম স্থানে, কেরল দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে গোয়া। পশ্চিমবঙ্গের স্থান ১৬ নম্বরে। এন্ডোক্রিনোলজিস্ট প্রবীর কুণ্ডুর কথায়, “এদের কিন্তু আলাদা কোনও চিকিত্সা নেই। নিয়মিত ব্যায়াম আর ডায়েট চালিয়ে যেতে হবে। মেদ বাদ দেওয়ার অস্ত্রোপচার এদের করা যাবে না। কারণ, ৩৫ বছর বয়সের আগে এই অস্ত্রোপচার করা উচিত নয়।” এন্ডোক্রিনোলজিস্ট নীলাঞ্জন সেনগুপ্তও একমত, “কেসটা সত্যিই বিরল। ব্যায়াম ও ডায়েট করে ওজন কমাতে অনেক সময় লাগবে।” |