অদ্ভুত আঁধার এক ...।
আচমকা বদলে গেল কড়া রোদের দুপুর। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘন কালো মেঘে জমাট অন্ধকারে শহর জুড়ে অসময়ের সন্ধে। অনেকটা ১৯৮০ সালের সেই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের স্মৃতি উস্কে দিয়ে। অন্ধকার এতটাই ঘনিয়ে আসে যে হেদুয়ার পাড়ের একটি কলেজের বাগানে বাসা বাঁধা বাদুড়েরাও বেপরোয়া ওড়াউড়ি শুরু করে। এর পরেই ঘনিয়েছে দুর্যোগ। বজ্রবিদ্যুত্-সহ এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে মহানগরী। যার বেশিটাই সইতে হয়েছে সল্টলেক এবং আশপাশের এলাকাগুলিকে।
এ দিন দুপুর আড়াইটে থেকে তুমুল বৃষ্টিতে বাজ পড়ে সল্টলেক ও দক্ষিণ শহরতলিতে মৃত্যু হয় দু’জনের। আহত হন আরও চার জন। শতাধিক গাছ পড়ে, জল জমে তুমুল যানজট হয় ই এম বাইপাস, সল্টলেক, বেলেঘাটা -সহ পূর্ব কলকাতা, বিদ্যাসাগর সেতু, বি টি রোড, দমদম, যশোহর রোডের বিস্তীর্ণ এলাকায়। |
তুমুল দুর্যোগে ভেঙে পড়েছে বহু গাছ। তারই মাঝখান দিয়ে পথ চলা।
সোমবার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সল্টলেক ক্যাম্পাস সংলগ্ন রাস্তায়। ছবি: শৌভিক দে। |
সল্টলেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের কাছে ট্যাক্সির উপরে গাছ পড়ে আহত হন চালক। জলমগ্ন হয় সল্টলেকের অফিসপাড়া, পাঁচ নম্বর সেক্টর সহ একাধিক জায়গা। বিঘ্নিত হয় বিমান পরিষেবাও। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়।
এক ঘণ্টার দুর্যোগে এ দিন কার্যত থমকে যায় শহর কলকাতা, সল্টলেক ও দুই শহরতলি। দুপুর সাড়ে তিনটের পর থেকে বাইপাস, রাজারহাট এক্সপ্রেসওয়ে, সল্টলেকের তিন নম্বর সেক্টর, বেলেঘাটা -ফুলবাগান, মানিকতলা, উল্টোডাঙা, যশোহর রোড, বিটি রোডের একাংশ সর্বত্রই যানজটের ছবিটা ছিল এক রকম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শম্বুক গতিতে চলাচল করেছে যানবাহন। দুর্ভোগে পড়েছেন নিত্যযাত্রী থেকে পথচারীরা।
বৃষ্টিতে বেহাল দশা সল্টলেকের তিন নম্বর সেক্টরে ইস্টার্ন ড্রেনেজ চ্যানেল ও যুবভারতী সংলগ্ন এলাকার। কোথাও গাছ উপড়েছে, কোথাও হাঁটুজল, কোথাও আবার ল্যাম্পপোস্ট উল্টে রয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন খালপাড়, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন থেকে চিংড়িঘাটা মোড় পর্যন্ত রাস্তায় একের পর এক গাছ উপড়ে যায়। সল্টলেক পুর -প্রশাসন অবশ্য জানিয়েছে, পনেরো -কুড়িটি গাছ পড়েছে। কোথাও আবার গাছের একাংশ বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে।
আচমকা দুর্যোগে দিশাহারা হয়ে পড়েন সল্টলেকের অফিসপাড়া, পাঁচ নম্বর সেক্টর ও নিউ টাউনের শিল্পতালুক এলাকার পথচারী থেকে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীরা। বিশেষত ভোগান্তি চরমে ওঠে রাজারহাট এক্সপ্রেসওয়েতে। যাত্রী প্রতীক্ষালয় না থাকায় খোলা আকাশের নীচেই অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের। বৃষ্টির সঙ্গে লাগাতার বাজ পড়ায় আতঙ্কও ছড়ায় যথেষ্টই। যেমন গড়িয়ার বাসিন্দা সৌমেন সাহা বলেন, “নিউ টাউনে কাজে এসেছিলাম। বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাজের ভয়ে কোনওমতে কাছাকাছি একটি ছাউনির নীচে আশ্রয় নিই। এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি।” |
হাওড়া স্টেশনের সামনে জলমগ্ন পথ। সোমবার। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার। |
নিউ টাউনের নারকেলবাগান বাস স্টপে ছাউনি না থাকায় বাজের ভয়ে দৌড়োদৌড়ি পড়ে যায়। এক যাত্রীর অভিজ্ঞতায়, “তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। সঙ্গে প্রচণ্ড বাজ। কোনও বাস, ট্যাক্সি কিছুই দাঁড়াচ্ছিল না।” আতঙ্কিত যাত্রীরা কেউ হিডকোর বারান্দায় উঠে পড়েন, কেউ বা ঢুকে পড়েন রবীন্দ্রতীর্থে।
স্রেফ সল্টলেক -নিউ টাউন নয়, বৃষ্টির জেরে যান চলাচল বিঘ্নিত হয় কলকাতাতেও। দৃশ্যমানতার অভাবে বিদ্যাসাগর সেতুতে দু’টি গাড়ির ধাক্কায় দুই যাত্রী আহত হন। তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনায় যানজট ছড়ায়। জল জমেও যান চলাচল মন্থর হয়ে পড়ে কিছু এলাকায়। জল থইথই হয়ে পড়ে হাওড়া স্টেশনের সামনের রাস্তা। বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ ফেসবুকে কলকাতা পুলিশ জানায়, উল্টোডাঙা স্টেশনের নীচে আন্ডারপাসে কোমর সমান জল জমে যায়, দমদম, পাতিপুকুর ও কাঁকুড়গাছি আন্ডারপাসে অবশ্য জল ছিল গোড়ালির উপর পর্যন্ত। অন্য দিকে বাইপাসে রুবি মোড়, সায়েন্স সিটি সার্ভিস রোড, মিলন মেলার ২ নম্বর গেট, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, মহম্মদ আলি পার্ক, ঠনঠনিয়া, মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের কোথাও গোড়ালি, কোথাও বা তার উপর পর্যন্ত জল জমে।
তবে জল জমে ও গাছ পড়ে যানজটে সবচেয়ে করুণ দশা হয় বাইপাসে সায়েন্স সিটি থেকে উল্টোডাঙামুখী লেনে, বেলেঘাটা মেন রোড ও খালপাড়, রাজারহাট এক্সপ্রেসওয়ে, সল্টলেকের তিন নম্বর সেক্টর থেকে বাইপাসমুখী একাধিক রাস্তায়। বিকেলে ধর্মতলায় যাবেন বলে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন সল্টলেকের বাসিন্দা শর্মিষ্ঠা গোস্বামী। আধ ঘণ্টা বিভিন্ন রাস্তা ঘুরেও বাইপাসে উঠতে পারেননি। শেষে কোনওক্রমে ফুলবাগান থেকে সুভাষ সরোবর হয়ে বেলেঘাটা মেন রোডের কাছে এসে আটকে পড়েন যানজটে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরে সেখান থেকেই ফের সল্টলেকে ফিরতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, “সল্টলেকের বেশ কয়েকটি রাস্তায় হয় গাছ উপড়ে রাস্তা আটকে, কিংবা যানজটে। এগোনো যাচ্ছিল না। এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি।”
বৃষ্টিতে সল্টলেকের অফিসপাড়া, সেক্টর ফাইভের পাশাপাশি মহিষবাথান, নয়াপট্টি, কুলিপাড়া থেকে সুকান্তনগরের মতো সংযুক্ত এলাকা ও দত্তাবাদেও জল জমে যায়। জল সরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। রাত পর্যন্ত লোডশেডিং চলে বহু এলাকায়।
ঝড়বৃষ্টির জন্য কিছুক্ষণ পরিষেবা ব্যাহত হয় বিমানবন্দরেও। বিমানবন্দর সূত্রে জানা গিয়েছে, নামতে না পেরে আকাশেই ঘুরতে থাকে কয়েকটি বিমান। বেশ কিছুক্ষণ পরে তাদের নামার অনুমতি দেওয়া হয়। |