এ যেন এক ঢিলে দুই পাখি! তবে ব্যাপারটা দুঃখকষ্টের এই যা!
গবেষকরা দাবি করছেন, মনের মধ্যে জমা দুঃখকষ্টের কথা লিখে ফেললে মন হাল্কা তো হয়ই! সেই সঙ্গে শারীরিক আঘাত-ক্ষতও জলদি মিলিয়ে যায়! শুনতে আশ্চর্য লাগলেও নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক কিন্তু এটা হাতেনাতে পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন। তাঁদের সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা আমেরিকান সাইকোসোমাটিক সোসাইটির জার্নালে সম্প্রতি ছাপাও হয়েছে। গবেষক দলের প্রধান তথা অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হেলথ সাইকোলজি’ বিভাগের সিনিয়র লেকচারার এলিজাবেথ ব্রডবেন্ট দাবি করছেন, ভয়ঙ্কর কষ্টের কোনও অভিজ্ঞতার কথা কেউ যদি লিখে ফেলেন, তা হলে আরাম হয় শরীরেরও। লেখার পরে যে শান্তির অনুভূতি তৈরি হয়, তাতে শরীরের আঘাত বা ক্ষত তাড়াতাড়ি নিরাময় হতে পারে।
কী রকম? গবেষকরা ৫০ জনের একটি দল বেছে নিয়ে ২৫ জনকে বলেছিলেন, তাঁদের জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা লিখে ফেলতে। বাকি ২৫ জনকে বলা হয়, আগামিকাল আপনার কী কী কাজ করার আছে, লিখে ফেলুন। লেখার দু’সপ্তাহ পরে ওই ৫০ জনের হাত থেকে অল্প একটু চামড়া তুলে নেওয়া হল। হাতে থেকে গেল সামান্য ক্ষত। দেখা গেল যাঁরা কষ্টকর অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছিলেন, ওষুধ লাগানোর পরে তাঁদের মধ্যে ৭২ শতাংশের ক্ষত একেবারে সেরে যায় ১১ দিনের মাথায়। অন্যদের ক্ষত মেলাতে সময় লাগল আরও অনেক বেশি এবং মাত্র ৪২ শতাংশের ক্ষত নিরাময় হল। ব্রডবেন্ট এই থেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন: ব্যক্তিগত কষ্টের কথা লেখার মাধ্যমে শারীরিক আঘাতের দ্রুত নিরাময় সম্ভব। |
ব্রডবেন্ট ই-মেলে জানিয়েছেন, “শারীরবৃত্তীয় ক্ষেত্রে এই ধরনের বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি কোনও প্রভাব ফেলে কি না, সেটা জানার উৎসাহ ছিল আমার। লেখার ফলে ক্ষত বা আঘাত দ্রুত সারছে, এটা বাহ্যিক ভাবে বোঝা গেল সহজে।” কেন এমন হয়? ব্রডবেন্টের মতে, দুঃখের অভিজ্ঞতা লিখে ব্যক্ত করলে মনে অনেক কম চাপ পড়ে। উদ্বেগ কম থাকে। অর্থাৎ স্ট্রেস হরমোনের দাপটও কম থাকে। স্ট্রেস হরমোন কম থাকলে ওষুধ দ্রুত কাজ করে। “ব্রডবেন্টের গবেষণার বিষয়টি কৌতূহল জাগায়”, বললেন মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম। “শারীরিক আঘাত কমার সঙ্গে মানসিক চাপের একটা সম্পর্ক তো অবশ্যই রয়েছে। স্ট্রেস কমলে শরীরের নিউরোট্রান্সমিটার সিস্টেমে প্রভাব পড়ে। যেটা আঘাত সারতে সাহায্য করে।”
এর আগেও এই ধরনের কিছু গবেষণা হয়েছে। যাতে দেখা গিয়েছে, মনের আবেগ ব্যক্ত করে লিখেছেন যাঁরা, সেই এইচআইভি রোগীদের রক্তে জীবাণুর দাপট কমেছে। এবং পাশাপাশি রোগ-প্রতিরোধকারী কোষগুলোর ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু মনের কথা কাউকে খুলে বললেও তো ভার কমে! লেখার গুরুত্ব আলাদা করে কোথায়? “কথা বলার জন্য কাউকে সব সময় পাওয়া যাবেই, এমনটা নয়। পেলেও তাকে সব বলতে পারা হয়তো যায় না। লেখার মধ্যে কোনও বাধো বাধো ভাব থাকে না” মত জয়রঞ্জনের। একই সঙ্গে তিনি বলছেন, “যখনই আপনি কিছু লিখতে শুরু করবেন, সেই বিষয়টা অনেক স্পষ্ট ভাবে, গুছিয়ে যুক্তিসঙ্গত ভাবে আপনার কাছে ধরা দেবে। মুখে বললে যেটা সম্ভব নয়।” মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রিমা মুখোপাধ্যায়ও মনে করেন, “শারীরিক আঘাত সারাতে লেখার অভ্যাস একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হতেই পারে। কারণ, মনে কোনও কষ্ট বা দুঃখ বোঝা হয়ে থাকলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। মনের কথা লিখে ফেললে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।” মনোবিদ সত্যজিৎ আশ অবশ্য বলছেন, কষ্টের স্মৃতি লিখে ফেললে বহিরঙ্গের ক্ষত নিরাময় হতে পারে কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিষয়টা এত সরল নয়। “কিন্তু শৈশবের কোনও কষ্টের স্মৃতি বহুদিন চেপে রাখায় শরীরে হয়তো কোনও রোগ বাসা বাঁধল। তখন সেই রোগীর চিকিৎসায় লেখা একটা ভূমিকা নিতে পারে।”
তার মানে কি লেখক-সাহিত্যিকরা এ ক্ষেত্রে খানিকটা বাড়তি সুবিধার জায়গায় আছেন? হয়তো কিছুটা, মানছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। কোনও কষ্টের অভিজ্ঞতা লিখে শারীরিক আরাম পেয়েছেন? শীর্ষেন্দু অবশ্য তেমনটা মনে করতে পারছেন না। তবে এটা মনে আছে যে, মায়ের মৃত্যুর আঘাত থেকে কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছিলেন না। পরে আনন্দবাজার পত্রিকার পাতাতেই মাকে নিয়ে লিখেছিলেন। তাঁর কথায়, “মাতৃশোক পেয়েছেন এমন অনেকেই নিজেকে খুঁজে পেলেন সেই লেখায়। দুঃখটা আর আমার একার রইল না।” একই রকম অভিজ্ঞতার কথা বললেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। “আট বছর বয়সে মা মারা যান। জীবনের শেষ মুহূর্তে তিনি দেখতে পাননি আমায়। এই যন্ত্রণা আমায় কুরে কুরে খেত।” ‘শঙ্খিনী’ উপন্যাসে সেটা লিখে ফেলার পর কিন্তু কষ্টটা আর অত তীব্র রইল না। কিন্তু এ সবই তো মনের আরাম। শরীরের আরামও হয় কি না, সেটা খেয়াল করতে হবে বলে জানাচ্ছেন তিনি।
অতএব? শোক-আঘাত পেলে এ বার থেকে ‘ও ভাই কানাই/কারে জানাই/দুঃসহ মোর দুঃখ’ বলে আক্ষেপ না করে কলম খুলে বসাই ভাল হবে, বলছেন গবেষকরা। তবে ব্রডবেন্টের সাবধানবাণী: “যন্ত্রণার কথা লিখলে সবারই যে মনের আরাম হবে, এমন না-ও হতে পারে। কারণ বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ভাবে দুঃখের সঙ্গে লড়াই করে।” |