|
|
|
|
|
|
|
বাংলাল্যান্ড |
সব্বাই এখন নিজের রাজ্য চাইছে। বাংলায় কতকগুলো টুকরো-টাকরা রাজ্য
হলে হয়
না? সেগুলোর হাবভাব কী রকম হবে? লিখেছেন চন্দ্রিল ভট্টাচার্য |
|
গাঙ্গুলিস্তান |
স্মার্ট, কুইজ-বিলাসী, স্ট্রং-মতামত’ওলা রাজ্য। ফুটবল ঢুকতে দেওয়া হয় না, প্রত্যেক ক্লাসে সেকেন্ড ল্যাংগোয়েজ ক্রিকেট (ফার্স্ট ল্যাংগোয়েজ চোস্ত ইংরিজি)। ডান হাতে ব্যাট করা বারণ। যে কোনও উল্লাস ঘটলে জামা খুলে ওড়ানো দস্তুর, কিন্তু তা মেয়েদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত নয়। রাজ্যের নারী-সমিতি এই বৈষম্য নিয়ে আপত্তি তুলে আন্দোলন শানাচ্ছে। নর-সমিতি সানন্দে সাপোর্ট। শিক্ষাব্যবস্থা বিতর্কিতজোর করে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে অন্তত তিন বার ফেল করানো হয়, যাতে তার ‘কামব্যাক স্পিরিট’ খুব শক্তপোক্ত বনে। ‘ফার্স্ট বয়ের কামব্যাক শেখার দরকার কী?’-র উত্তরে রাজ্য-উকিল ‘মহা-মনস্টার’-মূর্তি পানে আঁখ-গোলগোলিয়ে: এক গ্রেগে শীত যায় না! কাঁদুনি বা অজুহাতকে অ্যাক্কেরে প্রশ্রয় না দেওয়া রাজ্যটি উৎপাদনে দুরন্ত, কিন্তু ল্যাদাড়ুসের প্রতি বিশুদ্ধ ঠাটিয়ে-থাবড়া স্টান্স বহু সেন্টুস্থানে অস্বস্তি চোঁয়ায়। বাঙালি চির কাল পরাজিতের ব্রণ-গালে হামি বুলিয়ে ভোঁ, হেথা কাব্য-গান ‘জয়ের জন্য সব ছাড়া যায়, কোনও নেকু কারণেই জয়কে ছাড়া যায় না’ থিমে কাটারি-খরখর। ফলে রাজ্যবাসী ব্যর্থতার তোল্লাই-নেশা বা ‘স্বীকৃতি না-পাওয়াই প্রকৃত সিদ্ধি’ ধাস্টামি থেকে মুক্ত, অন্য পিঠে টুঁটি-টেপা রেসে নেমে দয়া ও ক্ষমাকে স্বেদ-ড্রপের সঙ্গে ত্যাগ করেছে। ‘আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে পুলিশ ভাল করে আত্মহত্যা করিয়ে দেবে’ বিলটি এখনও স্থগিত, তবে তা শুধু ভিনরাজ্যের দুয়ো-ভয়ে।
|
বাঁটুল দি গ্রেট স্টেট |
‘মন, মন, তোদের শরীর নাই রে কুসুম-শালা!’ স্লোগান-ওড়ানো রাজ্যে পেশি-নার্সিসাসামো সরকারি হাত্তালিপুষ্ট, মোড়ে মোড়ে এক্সএক্সএল আয়না, প্যান্ডালে জ্যান্ত অসুর সাজার ফ্যাশন (কুমোরপাড়া বিব্রত, ফি প্রতিমায় একটি অসুর কম হলে পয়সা কই?) কিন্তু মূল ইনোভেশন, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক রইরই : জিম ও আখড়ার কসরতগুলোকে রাস্তা সারাই, মাটি কাটা, ব্রিজ গাঁথার প্রোজেক্টে জুড়ে অভিনব ‘সামাজিক ব্যায়াম’ শুরু, নাগরিক বাইসেপ ও রাজ্যের পরিকাঠামো যুগলে ঊর্ধ্বগ্রাফী, পাড়ার সব্বাই রোজ কোদাল হাতে হাঁইহুপ-কোর্স হাঁকড়ালেই মাসখানেকে রেডি পদ্মপুকুর, আধ বছরে সিক্স-লেন হাইওয়ে। পুরসভার খরচা শূন্য, ফান্ড যায় শোয়ারজেনেগার-কে ‘রাজ্যশ্রী’ কম্পিটিশনে চিফ গেস্ট আনতে। ‘বেশি মাস্লবাজি করলে বুদ্ধি কমে যায়’ গাঢ় বং-ধারণার উত্তরে পিত্তি খিঁচিয়ে ‘মোটেই না, কক্ষনও না! আয় তোর দাঁত খুলে নিই!’-এর বদলে এ রাজ্যের বাঁধা ওভার-বাউন্ডারি: ‘বুদ্ধি কোন খেতের মুলো, যার জন্যে খোদ শরীরকে, আত্মা-বাড়িকে ইগনোর দেব? আমাশা-উবু হয়ে তোর লক্কা-ব্রেন কী এমন তির মারছে, যা আত্মবিশ্বাসী হাঁটু ও ফিট কলজের অধিক বুল’স আই? বাঁটুল-চালিশা লেখার জন্যে একটা পিংখাড়ু সভাকবি নাহয় ঘেঁটি ধরে এনে টাঙিয়ে রাখব, যাঃ!’
|
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
কেসিপাল তালুক |
সারা দুনিয়া ‘পৃথিবী সূর্যের চাদ্দিকে ঘোরে’ শিখে হাল্লাক হয়ে গেলেও তুমি ব্রিজে ল্যাম্পপোস্টে বাথরুমে সিলিঙে ‘সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে’ দাবড়ে ছয়লাপ করে দাও, কোনও শালাকে কেয়ার কোরো না এ কালাপাহাড়পনায় রাজ্য ধকধক করছে। হেথা অন্য স্বরকে শুধু ওয়েলকাম করা-ই হয় না, শুধু অন্য স্বরকেই ওয়েলকাম করা হয়। প্রথা ও শাস্ত্র হুড়িয়ে ভাঙতে ভাঙতে অ্যায়সা সিন, কেউ ‘দুপুরে ভাত খেলুম’ বললেও বেধড়ক গাঁট্টা। পৃথিবী ভাত খেলে এখানে চাউমিন সাঁটতে হবে, ফের মেজরিটি চাউমিনাচ্ছে বুঝলে সড়াৎ ভাতে ব্যাক। তাত্ত্বিকরা বলছেন, ‘এ তো রিভার্স ফ্যাসিজ্ম!’ কিন্তু রাজ্য গোঁয়ার ঘাড় শক্ত রাখে, মেনস্ট্রিম ছবির পোস্টার কুটিকুটি, কাব্য পড়ে বোঝা গেলে কবিকে নর্দমায় ফ্যালে, নিউটনকে চাঁটিয়ে চিক্কুর: ‘কটা আপেল দেখেছেন? বিশ্বে কোত্থাও একটা না একটা নির্ঘাত আছে যে ওপরে ছুড়লেই শোঁওও উড়ন্তি!’ সতীত্বকে এমন থুড়ে বিদ্রুপ, মেয়েরা ইচ্ছে না থাকলেও স্বামীর এক-আধটা বন্ধুর সঙ্গে শুয়ে পড়ে (‘গোমড়া অবৈধ’ একমাত্র এ রাজ্যে!) ভোটে বোঝা যাচ্ছে না, জনতা যাকে ভালবাসবে তাকে হারিয়ে দেবে কি না!
|
শাহরুখ নগর |
রাজ্যে কান্নাকাটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, গাল ব্যথিয়ে হাসো, প্রেমিকার নাম বলতে তোতলাও, আর্ট ফিলিম দেখো না, বগলে সুগন্ধি মাস্ট। পজিটিভ মাইন্ডসেট রাখতেই হবে, অ্যাক্সিডেন্টে ডান হাত কাটা গেলে ভাবো: বাঁ হাত তো আছে, নইলে ছোঁচাতাম ক্যায়সে? ধর্ষিতা হলে ভাবো: কত্ত মেয়ে হোল লাইফ সেক্স পেল না! বিন্দাস থাকো, মস্ত্ থাকো। ছেলেমেয়েদের পাঠাও রিয়েলিটি শো-তে, নিজেরা খাও এনার্জি ড্রিংক। মুখ্যমন্ত্রী দিনে ৩৩ ঘণ্টা কাজব্যস্ত, মুম্বই থেকে টেলি-কনফারেন্সে জিম করতে করতে মিটিং। কেউ মারকাটারি সমস্যার কথা তুললে স্বল্প খেপে যান। ‘প্রবলেম নিয়ে এসো না, সলিউশন নিয়ে এসো’ প্রচারিয়ে মুখে ফেকো। আইনশৃঙ্খলা, নলকূপ সাপ্লাই, গাঁয়ে পোলিয়ো টিকার পয়েন্ট শুনতে হাই ওঠে। তখন নিজ শুটিঙের রোমহর্ষক গপ্পো ফেঁদে বসেন। আমলারা লাল ফেলতে ফেলতে শোনেন, কফি ও অশান্তি জুড়িয়ে যায়। রাজ্যে ভিজিট করতে এসে খোলা জিপে বেড়ান, ভিখিরিকে বলেন, ‘শপিং মল থেকে নিট ও নিটোল ‘বেগিং-বোল’ কিনতে পারেনি?’, জিপ গত্তে পড়লে: ‘পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে বুজিয়ে দাও না ইয়ার!’
|
রবীন্দ্রখণ্ড |
ইংরিজি খিস্তি ব্যান। আকাশে উড়িছে রবীন্দ্রপাখি। রাজ্যবাসী মনে করেন, মুদির ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ, দোকানে ওজনদাঁড়ির দিকে তাকান না। ডবকা পড়শিকে দেখে, ঠেসে চুমু খাওয়ার বদলে প্লেটোনিক আত্মা-চকাম ফ্যান্টাসি। ইন শর্ট: ন্যাকা, স্লো-মোশনঋদ্ধ, পায়খানার মগকে ‘নির্মলমিত্র’ ডেকে আরাম পাওয়া টাইপ। রাজ্যে কোত্থাও অনাচারের খবর পেলেই দাঁত ছরকুটে ফিট। ‘অ্যাঁ? মার্ডার! ঠাকুরের আদর্শ তো মার্ডারকে সাপোর্ট করে না!’ যেন বিশ্বের কোনও মনীষীর, ফর দ্যাট ম্যাটার কোনও ভদ্রলোকের আদর্শই হত্যাকে শাবাশি দেয়, কিংবা ভগা-আলখাল্লার সিপিয়া-পরিধিতে কাঁকড়া বিছের অস্তিত্ব অসম্ভব। খোয়াইয়ে ধর্ষণ-কাম-খুনের পর পুলিশকত্তার আচাভুয়া সাফাই: ‘ভূগোল-গত ভাবে অপরাধটি যেখানেই ঘটুক, যে হেতু এই রবীন্দ্রাদর্শবিরোধী কাজ যে করেছে সে সত্তার দিক থেকে বহিরাগত, তার অপ-আঁচ লেগে কুকর্ম-কালীন ওই অঞ্চলটিও গিয়ে পড়েছিল রাজ্যের ল্যাটিটুড-লংগিটুড-অ্যাটিটুড-এর বাইরে’ দেশের সর্বত্র হরর ও হর্রা জাগায়।
|
জগদীশবসু প্রদেশ |
নন-ভেজ কম্পালসরি। কেউ সবজি খেলেই হাতকড়া। ‘জানেন না, গাছের প্রাণ আছে!’ কিন্তু স্যর, পাঁঠারও তো প্রাণ আছে মিনমিনালেই শাঁ-রদ্দা: অ্যাদ্দিন বেড়াতে-বেড়াতে আচমকা নিচু হয়ে তো পাঁঠার ঠ্যাং মুচড়ে ছেঁড়েননি, প্রেম করতে বসে খামকা মুঠো মুঠো ঘাস ফেড়েছেন ক্যান? বিয়ের রাতে সতেরোশো ফুলের মৃতদেহ ধাম্সাবার নিয়ম করেছেন কোন এথিক্সে? মাছ-মাংসে অবাস্তব ছাড়, রাজ্য-কোলেস্টেরল তুঙ্গে। টেররিস্ট গ্রুপ লুকিয়ে লালশাক দিয়ে চাড্ডি ভাত খায়।
|
অমর্ত্যপুর |
হেভি বোর রাজ্য। আদ্ধেক লোক পালিয়েছে। প্রকাণ্ড পড়াশোনা করতে হয়, টিভি থেকে নির্মম ছেঁটে ফেলা হয়েছে চুটকি শো, কলতলা-কোলাহল, বামন-তোল্লাই। গরগরে সিরিয়াল ছেড়ে তবে চাষিভাইয়ের মাজরা পোকা মোকাবিলা নিয়ে হ্যাজানি দেখব? আইপিএল টেলিকাস্ট বন্ধ করার পর ভাঙচুর হল, মুখ্যমন্ত্রীর কাঁচকলা। বললেন, তা, ভেঙেই দিয়েছেন যখন, কিছুই আর দেখতে পাবেন না, বসে থাকুন। যাশ্লা, আমরা ভাঙব, তোরা ভয় পাবি, আলোচনায় বসবি, এ-ই তো নিয়ম। বেশি আঁতলা হলে যা হয়, গোটা রাজ্য কষ্টা, নিরানন্দ। জলসা নেই। ইতুপুজোয় ছুটি নেই। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল বন্ধ। ওই টাকায় নাকি চাট্টি হাসপাতাল-বেড, পাঁচটি টিউকল। ঠিকই, গরিবি কমেছে, ইলেকট্রিসিটি কোণে কোণে, শিক্ষার হার পাঁইপাঁই, তাতে কী? গ্রামসাইড-ও খচে ফায়ার। মুখ্যমন্ত্রী ধমকেছেন, মোবাইল কেনা বন্ধ রাখুন, আটা কিনুন। নিজের দাঁত মাজুন, পরে ব্লু-টুথ বুঝবেন। দাঁড়াও, নোবেল চুরি গেল বলে!
|
হরিদাস পাল হল্ট |
সাধারণ মানুষ যার টিপেটাপে পটল কেনা ব্যতীত নৈপুণ্য নেই তাকে মুখ্যমন্ত্রী-গদিতে চিপকে দেওয়ার স্ট্র্যাটেজি হিন্দি সিনেমা থেকে ঝেড়ে বাস্তবে একটা রাজ্য বানানো যায়, ভাবা যায়নি। কিন্তু হ্যাপিয়েস্ট স্টেট। মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন চোরকে গাঁতিয়ে গণধোলাই দেওয়া উচিত, ওয়ান-ডে’তে পাকিস্তানকে সাপোর্ট করলে তার পাছায় পিঁপড়ে লেলাও, মেয়েরা খুদে স্কার্ট পরলে আওয়াজ খাবেই (প্রোভোক করেছে)। আবার যে মঙ্গলবার রেপ করেছে বুধেই তার প্রকাশ্য ফাঁসি, লাইভ টেলিকাস্ট সরকারি চ্যানেলে। বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের এ জমিনে প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষকে জিজ্ঞেস করে কাজ করা হয়, পকেটমার পাকড়ে বাসের লোককে চিল্লে জিগানো নিয়ম, ‘কী চান?’ অধিকাংশের ডিম্যান্ড: আঙুলগুলো সাঁড়াশি দিয়ে প্লাক, ব্যস, অন-স্পট দণ্ড লাগু। কোম্পানির প্রাইভেটাইজেশনও ও-ভাবেই। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আমোদ-জটলা, এর পাছায় বেত চলছে, ওর চোখ গেলে দেওয়া হচ্ছে, কুলটা মেয়েকে বিবস্ত্র করে হাঁটানো হচ্ছে, পয়সা দিলে মোলেস্ট করা অ্যালাও। মানুষ দু’হাত তুলে প্রশাসনকে আশীর্বাদ করে করে হাতে স্পন্ডি। মানুষকে আলাদা করে দাবি ফুকারিতেও হয় না, জানে: সে যা ভাবছে, তার সাদামাটা ভাই-বাবা-সন্তান মুখ্যমন্ত্রীও এগজ্যাক্টলি তা-ই ভাবছেন। ফলে স্টেটই নাগরিক, নাগরিকই স্টেট। মেট্রোর ভাড়া কত? আপনি যা দেবেন! |
|
|
|
|
|