পঞ্চায়েত ভোটের সাফল্যে ভর করে রাজ্যশাসনে নতুন গতি আনতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তার প্রথম ধাপ হিসেবে মুম্বই গিয়ে এ রাজ্যে লগ্নির জন্য আহ্বান জানিয়ে এসেছেন শিল্পপতিদের। আর দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে মঙ্গলবার পর্যালোচনা করলেন মন্ত্রী-আমলাদের কাজকর্ম। তাতে ভাল কাজ করা মন্ত্রীরা যেমন প্রশংসা পেয়েছেন, তেমনই বকুনি খেয়েছেন বেশ কয়েক জন। এ ব্যাপারে তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মন্ত্রীরাও ছাড় পাননি বলে মহাকরণ সূত্রে খবর। পাশাপাশি প্রশাসনের কাজে গতি আনতে এ দিন লাল ফিতের ফাঁস খুলে গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলিকে আর্থিক স্বাধীনতা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
টাউন হলের পর্যালোচনা সভায় মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ, ওই দফতরের সচিব রাজীব সিংহ, আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটক, জলসম্পদমন্ত্রী সৌমেন্দ্রনাথ মহাপাত্র, আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ সচিব সঞ্জয় থাড়ের কাজকর্মের প্রশংসা করেছেন বলে প্রশাসনের অন্দরমহলের খবর। মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের এক কর্তা বলেন, “বাজেট বরাদ্দ খরচের দিক থেকে যে দফতরগুলি এগিয়ে আছে, এ দিন তাদেরই প্রশংসা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।” |
অন্য দিকে, পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম, পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদারের দফতরের কাজে মুখ্যমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গিয়েছে। মহাকরণের এক কর্তা জানান, নিজের ঘনিষ্ঠ ববিকে ধমক দিয়ে মমতা বলেছেন, অনেক দিন আগে টাকা বরাদ্দ করা হলেও পুর দফতরের অনেক কাজ আটকে রয়েছে। এমনকী ববির উদ্দেশে এ-ও বলেছেন যে, দ্রুত গতিতে কাজ শেষ করতে না-পারলে দায়িত্ব ছেড়ে দিলেই ভাল হয়। একই রকম ভাবে পরিবেশ দফতরের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ মন্থরগতিতে চলায় সমালোচিত হয়েছেন সুদর্শনবাবু।
কর্তাটি আরও জানাচ্ছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাতে থাকা তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের কাজ খতিয়ে দেখার সময় দফতরের সচিবকে মমতা বলেন, এখানে অনেক কিছু করার ছিল। কিন্তু সে সব কমই হয়েছে। এ বার থেকে এ সব তাঁকেই দেখতে হবে বলেও মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জলপথ পরিবহণের যথেষ্ট উন্নতি না-হওয়ায় এবং ভ্যানোর লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি এখনও বকেয়া থাকায় মৃদু ধমক খেয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রও। জঙ্গলমহলে উন্নয়নের কাজ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী সুকুমার হাঁসদাকে সময়ে প্রকল্প শেষ করার ব্যাপারে জোর দিতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী।
তাঁর নিজের হাতে থাকা সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজেও তেমন অগ্রগতি হয়নি বলে মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে জানান। এ জন্য দফতরের পদস্থ আমলাদের সমালোচনা করেন তিনি। পাশাপাশি বলেন, বাজেটের টাকা তেমন খরচ করতে পারেনি প্রাণীসম্পদ বিকাশ দফতরও। ওই দুই দফতরের মন্ত্রী-সচিবকে আরও মন দিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন মমতা। পর্যটনসচিব বিক্রম সেনের কাজেও তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে খবর।
এ দিনের বৈঠকেই মুখ্যমন্ত্রী জেলাশাসকদের জানিয়ে দিয়েছেন, উন্নয়নের কাজকর্ম খতিয়ে দেখতে অক্টোবরের গোড়া থেকেই আবার জেলা সফরে বেরোবেন তিনি।
প্রশাসনের কাজে গতি আনতে এ দিনের বৈঠকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এক, উন্নয়নের খাতিরে বাজেট বরাদ্দের পরেও যদি খরচের অদলবদলের প্রয়োজন হয়, তা এখন থেকে দফতরগুলি নিজেরাই করে নিতে পারবে। (আর্থিক পরিভাষায় ‘রি-অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন’) এত দিন অর্থ দফতরের অনুমোদন ছাড়া এ কাজ করা যেত না। এবং দুই, প্রতিটি দফতরেই আর্থিক উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে।
মহাকরণ সূত্রে বলা হচ্ছে, উন্নয়নের কাজে সরকারি লাল ফিতে যাতে বাধা না-হয় সে জন্য গত বছরেই অর্থ দফতরের বেশ কিছু নিয়মে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। নির্দেশ দিয়েছিলেন, বরাদ্দ বাজেটের মধ্যে থেকে যে কোনও প্রকল্পের ছাড়পত্র দিতে পারবেন দফতরের সচিবেরাই। তার জন্য প্রতি পদে অর্থ দফতরের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। সেই কাজ ত্বরান্বিত করতেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দফতরে আর্থিক উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিল অর্থ দফতর। এ বার সব দফতরই সেই সুবিধা পাবে।
এক মন্ত্রীর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রতি দফতরেই কার্যত একটা মিনি অর্থ দফতর তৈরি হয়ে গেল। পরিকল্পনা বরাদ্দ খরচের ক্ষেত্রে লাল ফিতের ফাঁস বলে আর কিছু রইল না।” |