নানা রঙে রঙিন দুই মহকুমায় গ্রাম পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠন
মানসের খাসতালুকে সিপিএম-তৃণমূল দোস্তি
ভোট মিটেছে। বেরিয়ে গিয়েছে ফলাফল। তবু অঙ্কের হিসেব চলছেই। মেদিনীপুর ও খড়্গপুর মহকুমায় গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে বোর্ড গঠনের দিন সেই সব নানা অঙ্কই প্রকাশ্যে এল। কোথাও সিপিএমের প্রতীকে জিতে আসা প্রার্থীকে প্রধান পদে সমর্থন করল তৃণমূল, কোথাও টসে জিতে প্রধানের পদ পেল সিপিএম, উপপ্রধান তৃণমূলের। কোথাও প্রধান পদে নির্বাচিত হলেন তৃণমূল প্রার্থী, উপপ্রধান পদে কংগ্রেস প্রার্থী। শাসকদলের প্রার্থীকে ভোটাভুটিতে হারিয়ে তৃণমূলেরই আর এক প্রার্থী প্রধান হলেন, এমন ঘটনাও ঘটল।
সবংয়ের ছবিটা বৈচিত্র্যে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এখানে গাঁটছড়া বেঁধেছে সিপিএম-তৃণমূল। সবংয়ের বুড়াল গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রধান হয়েছেন সিপিএমের প্রতীকে জিতে আসা শেখ রফিক। উপপ্রধান তৃণমূলের সন্দীপ খাটুয়া। এই পঞ্চায়েতের ১৫টি আসনের মধ্যে সিপিএম দখল করে ৫টি আসন। তৃণমূল ৪টি। কংগ্রেস ৬টি। এ দিন তৃণমূল-শিবির থেকে রফিকের নাম প্রধান পদে প্রস্তাব করা হয়। সবংয়ের তৃণমূল নেতা তথা জেলা পরিষদের জয়ী সদস্য অমূল্য মাইতির ব্যাখ্যা, “ওই পঞ্চায়েত সদস্য আগেই দলবদল করে তৃণমূলে এসেছেন। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই!” যদিও সিপিএমের সবং জোনাল কমিটির সম্পাদক অমলেশ বসুর দাবি, “আমাদের তো জানাই ছিল না। সব দিক খতিয়ে দেখে যা পদক্ষেপ করার করব।”
দণ্ডরা গ্রাম পঞ্চায়েতেও এক ছবি। এখানে প্রধান সিপিএমের মাধবচন্দ্র পাত্র, উপপ্রধান কংগ্রেসের গীতা সিংহ। এই গ্রাম পঞ্চায়েতে উপপ্রধান পদটি তফসিলি উপজাতির মহিলা সংরক্ষিত। কিন্তু সিপিএমের কোনও তফসিলি উপজাতির মহিলা কোনও প্রার্থী জয়ী হননি। তাই বোর্ড গঠনে এই সমীকরণ। বিষয়টিকে প্রচারের হাতিয়ার করতে চাইছে কংগ্রেস। ওই এলাকাতেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএমের প্রভাবশালী নেতা হরেকৃষ্ণ সামন্তের বাড়ি। সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার প্রশ্ন, “আলিমুদ্দিনে বসে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্রেরা তৃণমূলের অনাচারের বিরুদ্ধে গরম গরম বক্তৃতা দিচ্ছেন! তাঁদের কমরেডরা তৃণমূলের হাত ধরেছেন, তাঁরা কি জানেন না? নাকি এটা নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কি তাঁর দলের কাজ সম্পর্কে সচেতন?”

মেদিনীপুরের শিরোমণি পঞ্চায়েতে শপথগ্রহণ। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
পঞ্চায়েত স্তরে স্থানীয় ভিত্তিতে বোঝাপড়া পরিচিত ছবি। কংগ্রেসেও পরিস্থিতি সাপেক্ষে কোথাও বাম কোথাও বা তৃণমূলের হাত ধরেছে। মানসবাবুর খাসতালুক সবংয়েরই দশগ্রাম পঞ্চায়েতে সমঝোতা করেছে তৃণমূল আর কংগ্রেস। প্রধান হয়েছেন তৃণমূলের সঞ্চিতা বাগ। উপপ্রধান কংগ্রেসের অনিল সাঁতরা। এই গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৩টি আসনের মধ্যে সিপিএম জিতেছে ৫টিতে। সিপিআইয়ের ২টি। তৃণমূলের ৪টি। এবং কংগ্রেসের ২টি। সিপিএমের ৫ জন বোর্ড গঠনে যোগ দিতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে মানসবাবুর যুক্তি, “আমরা তো বলেইছিলাম, এ সব ক্ষেত্রে স্থানীয় স্তরেই সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু যে তৃণমূল সিপিএমের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কটের ফতোয়া দিয়েছে, যে সিপিএম তৃণমূলকে সন্ত্রাসবাদী দল বলে চিহ্নিত করেছে, এমন উত্তপ্ত আবহাওয়ায় তারা হাত মেলায় কী করে?”
খড়্গপুর ২ ব্লকে আবার প্রধান পদের জন্য সিপিএম প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করে তৃণমূল। প্রধান হয়েছেন সিপিএমের প্রতীকে জয়ী পঞ্চায়েত সদস্য রেবতী কিস্কু। এই গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৪টি আসনের মধ্যে তৃণমূলের দখলে আসে ৮টি আসন। বামফ্রন্টের দখলে আসে ৬টি। প্রধানের পদটি এসটি মহিলা সংরক্ষিত ছিল। অথচ, তৃণমূলের এসটি মহিলা কোনও প্রার্থী জয়ী হননি। এ দিন তৃণমূল-শিবির থেকে রেবতীদেবীর নাম প্রধান পদের জন্য প্রস্তাব করা হয়। ভোটাভুটি হয়। রেবতীদেবী ১০টি ভোট পান। তৃণমূলের বক্তব্য, রেবতীদেবী-সহ ফ্রন্টের ২ জন সদস্য আগেই দলবদল করে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।
মেদিনীপুর এবং খড়্গপুর মহকুমার ১৬টি ব্লকের ১৬৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনের দিন ছিল সোমবার। সকাল থেকে শাসক-বিরোধী, দুই শিবিরে ছিল উত্তেজনা। বোর্ড গঠন ঘিরে বিক্ষিপ্ত কিছু সংঘর্ষও হয়। কোথাও সিপিএম-তৃণমূলে, কোথাও বা তৃণমূলেরই দুই গোষ্ঠী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। জখম হন বেশ কয়েকজন। কিছু এলাকায় বাম সদস্যদের বোর্ড গঠনে যোগ দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের মতে, “ভোটের দিনও সন্ত্রাস হয়েছে। বোর্ড গঠনের দিনও বিভিন্ন এলাকায় জোরজুলুম চলল।” অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছে তৃণমূল। দলের জেলা সভাপতি দীনেন রায় বলেন, “সমস্ত কিছু সুষ্ঠু ভাবেই হয়েছে। কোথাও গোলমাল হয়নি। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটেছে মাত্র। তাও আমরা সমর্থন করি না।” তাঁর কথায়, “এতো সুষ্ঠু ভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচন আগে কখনও এ জেলায় হয়েছে? মানুষ উৎসবের মেজাজে ভোট দিয়েছেন। শুধু অপপ্রচার আর কুৎসা।”
গোলমালের আশঙ্কায় এ দিন কিছু এলাকায় ১৪৪ ধারাও জারি করা হয়েছিল। গড়বেতা-১ ব্লকের বেনাচাপড়া, আমকোপা, গড়বেতা-২ ব্লকের জিরাপাড়া, পিংবনি, গড়বেতা-৩ ব্লকের কড়সা, নলবনা প্রভৃতি এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি থাকায় সকাল থেকেই ছিল বাড়তি পুলিশি নজরদারি। তবে কেশিয়াড়ি ব্লকের কেশিয়াড়ি এবং পিংলা ব্লকের জামনা, এই দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েতে এ দিন প্রধান নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। দু’টি ক্ষেত্রেই প্রধান পদ ছিল অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে তৃণমূল জিতলেও তাদের কোনও ওবিসি প্রার্থী জেতেননি। ফলে, জটিলতা বাড়ে। বামেদের জয়ী ওবিসি প্রার্থীরা আবার বোর্ড গঠনে যোগ দিতে পারেননি।

খেলাড়ে কংগ্রেস সদস্যকে পুলিশি পাহারা। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
অভিযোগ, তৃণমূলের লোকেরা তাদের বাধা দিয়েছে। তবে দু’টি পঞ্চায়েতেই উপপ্রধান নির্বাচন হয়েছে। কেশিয়াড়ির উপপ্রধান হয়েছেন তৃণমূলের শেফালি পাহাড়ি। জামনার উপপ্রধান তৃণমূলের শেখ মফিজুল। ডেবরার ডুঁয়া-২ পঞ্চায়েতে টসে প্রধান-উপপ্রধান নির্বাচন হয়। এই পঞ্চায়েতের ১২টি আসনের মধ্যে সিপিএমের দখলে ৬টি, তৃণমূলের দখলে ৬টি আসন। টসে মাধ্যমে প্রধান নির্বাচিত হন সিপিএমের ফুলমণি মুর্মু। উপপ্রধান নির্বাচিত হন তৃণমূলের সমীর গাঁতাইত।
পরিবর্তনের অন্য ছবি ডেবরায়। দশ বছর পর স্থানীয় খানামোহন গ্রাম পঞ্চায়েত হাতছাড়া হয়েছে তৃণমূলের। ক্ষমতায় ফিরেছে সিপিএম। এই পঞ্চায়েতের ১৬টি আসনের মধ্যে সিপিএম জিতেছে ৮টিতে, তৃণমূল ৫টিতে, বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নির্দলরা ৩টিতে। ভোটের পর ‘বিক্ষুব্ধ’ নির্দলদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা হয়েছিল। শেষমেশ তা সম্ভব হয়নি। তৃণমূলের ডেবরা ব্লক সভাপতির রতন দের তাই আক্ষেপ, “নির্দলরা সমর্থন করল না বলেই সিপিএম পঞ্চায়েত দখল করল!” গড়বেতা-১ ব্লকের গরঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূলের প্রার্থী মিতা রাণাকে ভোটাভুটিতে হারিয়ে জেতেন তৃণমূলেরই সুভাষ মাজি। সুভাষবাবু দীর্ঘদিন দলের ব্লক সভাপতি ছিলেন। রাজ্যে পালাবদলের পর দলবিরোধী কাজের অভিযোগে বহিষ্কৃত হন। পরে ফের দলে ফেরেন। এই গ্রাম পঞ্চায়েতে ১২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল জিতেছে ৮টিতে। কংগ্রেসের দখলে ৪টি আসন। এ দিন শুরুতে তৃণমূলের ‘ক্ষমতাসীন’ শিবির প্রধান পদের জন্য মিতাদেবীর নাম প্রস্তাব করে অন্য শিবির সুভাষবাবুর নাম দেয়। ভোটাভুটি হয়। পরে দেখা যায়, মিতাদেবী ৫টি ভোট পেয়েছেন। সুভাষবাবু ৭টি ভোট পেয়েছেন। গোষ্ঠী কোন্দল প্রকাশ্যে আসে কেশপুরেও। ব্লকের কলাগ্রাম, এনায়েতপুর এবং কেশপুর, এই তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠী প্রধান পদের জন্য পৃথক নাম প্রস্তাব করে। দলের কেশপুর ব্লক সভাপতি তপন চক্রবর্তী অবশ্য বলেন, “এ সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা।”
দু’টি মহকুমার ১৬৩টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৬১টিতে এ দিন প্রধান নির্বাচন হয়েছে। পাল্লা ভারী তৃণমূলেরই। ১৩৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতে শাসকদলের প্রার্থী প্রধান হয়েছেন। সিপিএমের প্রধান ১৫টি পঞ্চায়েতে, সিপিআইয়ের একটিতে, কংগ্রেসের ৫টিতে ও নির্দল প্রধান হয়েছেন ৩টি পঞ্চায়েতে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.