শব্দদূষণজনিত বধিরতা এখন পরিচিত ব্যাধি। ৭০ শতাংশ দূষণের উদ্ভবই গাড়ির হর্ন থেকে। অথচ
হর্ন বাজানোর বিপত্তি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ আশ্চর্য রকমের নিস্পৃহ। বধিরতা প্রাণঘাতী নয় বলেই কি?
মধুমতী দত্ত ও পরিমল ঘোষ |
যদি বলি কলকাতার মানুষ নিজের ঢাক নিজে পেটাতে ভালবাসেন, তর্ক উঠতে পারে। কিন্তু কোনও সন্দেহ নেই কলকাতার গাড়িচালকরা নিজের গাড়ির হর্ন বাজাতে পছন্দ করেন। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের ২০০৯ সালের সমীক্ষা অনুসারে এখানে প্রতি ৩ সেকেন্ডে এক বার হর্ন বাজে। সারা দুনিয়ায় যেখানে হর্নের গড় শব্দমাত্রা ১১০ ডেসিবেল, সেখানে ভারতের শহরগুলিতে তা ১৩০ ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের কলকাতায় জমজমাট এলাকাগুলিতে সব মিলিয়ে গড়পড়তা কোলাহলের শব্দমাত্রা ৮৭ ডেসিবেল, যা কিনা ভারতের মেট্রোপলিটন শহরগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ ও ২০০০ সালের শব্দ নিয়ন্ত্রণ বিধির নির্দিষ্ট মাপের চেয়ে অনেক বেশি।
শব্দদূষণজনিত বধিরতা এখন পরিচিত ব্যাধি। সাধারণ কথাবার্তার জোর ৬০ ডেসিবেলের মধ্যেই থাকে। সেই মাত্রা ৮০ ছাড়ালে আমাদের কষ্ট হয়, বস্তুত বেশ কিছু ওয়েবসাইট অনুসারে মিনিট পনেরো যদি ৮০ ডেসিবেলের শব্দ আমাদের টানা শুনতে হয়, বা ক্ষণেকের জন্যও ১৪০ ডেসিবেলের পাল্লায় আমরা থাকি, তা হলে আমরা পাকাপাকি ভাবে বধির হয়ে যেতে পারি। তাই কলকাতার রাস্তায় যে-সমস্ত মানুষ লাগাতার হর্নের বাজনা শুনতে বাধ্য হন, যেমন পুলিশ, ট্যাক্সিচালক বা দোকানদার, তাঁরা নিশ্চিত বধিরত্বের দিকে এগিয়ে চলেছেন। বেঙ্গালুরুর একটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, আগে সাধারণত ৬০ বছরের বেশি মানুষরাই শ্রবণযন্ত্রের সাহায্য নিতেন। এখন গড়পড়তা বয়স ৫০-এর নীচে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘটনা হল, এই জাতীয় বধিরত্ব খুবই ধীর গতিতে ও যন্ত্রণাহীন ভাবে শুরু হয়। টেলিভিশনের আওয়াজ একটু জোরে করে নিতে হয়, ভিড়ের মধ্যে কথা শুনতে অসুবিধে হয়, বা কানে হয়তো মাঝেমধ্যে ভোঁ-ভোঁ করে। ফলে মানুষ প্রথমে খেয়ালই করে না। অসুখ যখন ধরা পড়ে, অর্থাৎ বধিরত্ব যখন প্রমাণিত হয়, তখন প্রায়শই অনেক দেরি হয়ে গেছে। |
বধিরত্ব প্রাণঘাতী নয় বলে একে আমরা তেমন গুরুত্ব দিই না। মানুষটা হাসিঠাট্টার শিকার হয়ে পড়েন, সামাজিক ক্রিয়াকলাপে তেমন অংশ নিতে পারেন না। অনেক সময় রুজিরোজগারের জায়গায়ও অকেজো বা দুর্বল প্রমাণিত হন। শব্দদূষণ-জনিত বধিরত্বকে জন্মসূত্রে বধিরত্বের সঙ্গে এক করে দেখলে ভুল হবে। দ্বিতীয় ধরনের অসুবিধা যাঁদের, তাঁরা শৈশব থেকে এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে ভাগ্যবানরা স্কুলবেলা থেকে হাতের নানা মুদ্রা ব্যবহার করতে শেখেন, নিজের মতো করে একটা সামাজিক জীবনও তৈরি করে নিতে পারেন। বেশি বয়সে বধির হয়ে যাওয়া মানুষদের সেই সুবিধা থাকে না।
অথচ কলকাতায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আজ পর্যন্ত মূলত বাজি-পটকার উপর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দেখে নেওয়া যাক, আমাদের দেশের আইনের ব্যবস্থা কেমন। সংবিধানের ২১ নং ধারা, অর্থাৎ জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারকেই ব্যবহার করা যেতে পারে শব্দের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য। এ ছাড়াও দণ্ডবিধির চতুর্থ পরিচ্ছেদের ২৬৮ থেকে ২৯৫ ধারা শব্দদূষণের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা চলে। ২০০০ সালের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণবিধি অনুসারে চার ধরনের এলাকা চিহ্নিত করা গিয়েছিল শিল্পাঞ্চল, বাণিজ্যিক অঞ্চল, মানুষের বসবাসের এলাকা ও হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আদালতগুলির একশো মিটারের মধ্যে একটি পূর্ণ নৈঃশব্দ্যের এলাকা। গ্রহণীয় মাত্রা হিসেবে স্থির হয় সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবেল (দিনের বেলায় শিল্পাঞ্চলে) থেকে সর্বনিম্ন ৪০ ডেসিবেল (হাসপাতাল ইত্যাদি অঞ্চলে, রাত্রে)। সেই অনুসারে শব্দবিধি রচিত হয় ও রাজ্য সরকারগুলির উপর তা প্রয়োগ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সমস্যা হল, এই সব নিয়ম পালন করা প্রায় অসম্ভব। গড় শব্দমাত্রা নির্ধারণ করা বা এলাকাগুলিকে আলাদা করে নির্দিষ্ট করা বাস্তবে কঠিন। কোনও গাড়িচালকের পক্ষে জানাও সম্ভব নয় কোন এলাকায় বৈধ মাত্রা কী। তা ছাড়া, নির্দিষ্ট করা মাত্রাগুলির পিছনে যুক্তিই বা কী, তাই নিয়ে প্রশ্ন ছিল। শব্দদূষণ সবাইকেই পীড়িত করে, শুধু অসুস্থ মানুষ, ছাত্রছাত্রী বা বিচারকদের নয়। বস্তুত সবচেয়ে বেশি সুরক্ষার প্রয়োজন তাঁদের, যাঁরা অনেকটা সময় রাস্তায় কাটাতে বাধ্য হন। এই শব্দবিধিতে সব ধরনের আওয়াজ সম্বন্ধে বলা হয়েছিল, যদিও কার্যকর করতে গেলে বিভিন্ন রকম আওয়াজের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে। গাড়ির হর্ন থেকেই প্রায় ৭০ শতাংশ দূষণের উদ্ভব, কিন্তু তার জন্য আলাদা করে প্রায় কিছুই বলা হয়নি।
কলকাতায় সরকারি হাসপাতালের আশেপাশে হর্ন নিষিদ্ধকরণের বোর্ড ঝোলানো হয় এবং সময় সময় এন জি ও-গুলিকে প্রচারের কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সমীক্ষা থেকে প্রমাণিত, গাড়িচালকরা এই ধরনের বোর্ড খেয়ালই করেন না। এক দিনের প্রচার সাধারণ মানুষের মনে যে বিশেষ ছাপ ফেলে না, তাও বোঝা গিয়েছে।
কিন্তু আমাদের, সাধারণ ভাবে ভারতীয় ও বিশেষ করে কলকাতার লোকজনদের হর্ন বাজানোর এই বাতিকের কারণ কী? এই বাতিকের জন্যই কিন্তু গাড়ি নির্মাতারা আমাদের দেশের জন্য হর্নের জোর আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় বাড়িয়ে রাখেন। জার্মান কোম্পানি অডি-র ভারতীয় বাজারের ডিরেক্টর বলেছেন যে, ভারতের বাজারের জন্য তাঁরা জোরালো ও টেকসই হর্নের ব্যবস্থা রাখেন। মোটামুটি একই মত জেনারেল মোটরস-এর প্রধান আধিকারিকের ভারতীয় চালকদের হর্নকে বাদ দিয়ে ভাবাই যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, হর্ন বাজনোর বাতিকের পিছনে সাধারণ ভাবে নানা কারণ কাজ করে চালকের রাগ, আশংকা, ক্ষমতা দেখানোর তাগিদ, এক ধরনের মস্তানি ইত্যাদির পাশাপাশি একটি ধ্রুব বিশ্বাস যে, হর্ন না বাজালে গন্তব্য স্থলে পৌঁছতে দেরি হবে। আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে চালকের অধৈর্যের কথাও বলতে হবে, নয়তো ট্রাফিক সিগনাল সবুজ হওয়ামাত্র পিছনের গাড়িগুলির হর্ন বাজানোর কোনও কারণ থাকতে পারে না। চালকরা যেন ভুলেই যান যে, সামনের দিকের গাড়িগুলিও কোথাও না কোথাও দ্রুত পৌঁছতে চাইছে। আবার আচমকা যদি কেউ সামনে এসে পড়ে, সেই আশংকা থেকেও চালকরা হর্ন বাজাতে বাজাতে যেতে পছন্দ করেন। আমাদের এক জন এক ট্যাক্সিচালককে কথাটা জিজ্ঞেস করতে তিনি বলেছিলেন কী করব, কলকাতার লোকেরা যে কানে শুনতে পায় না! এটাও মানতে হবে, খারাপ রাস্তা, ফুটপাথের অভাবের কারণে পথচারীদের রাস্তা দিয়ে চলার অভ্যাস ও নানা গতির বিচিত্র যানের উপস্থিতি হর্ন বাজাতে অনেক সময় চালকদের বাধ্য করে।
আর একটি গুরুতর কারণের কথাও বলতে হয়। তা হল, হর্ন বাজানোর বিপত্তি সম্বন্ধে সাধারণের আশ্চর্য অজ্ঞানতা বা নিস্পৃহতা।
আমাদের দেশের রাস্তার হাল খুব তাড়াতাড়ি বদলে যাবে এমন ভরসা করার কারণ নেই। অন্য দিকে, ভারতীয় গাড়িচালকরা শ্রেণি হিসেবে হর্ন বাজাতে ভালবাসেন বললে কিছুই করার থাকে না। বাকি থাকে দুটি উপায়। প্রথমত, নিয়মবিধির কিছু পরিবর্তন আনা সম্ভব। জোরে হর্ন বাজানোর শাস্তি হিসেবে ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ক্রমবর্ধমান হারে জরিমানা আদায়ের কথা ভাবা যেতে পারে। এক-এক এলাকায় এক-এক রকমের শব্দবিধির জায়গায় সর্বত্র ডেসিবেলের একটিই মাত্রা ধার্য করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। ট্রাফিক পুলিশদের এ বিষয়ে কড়া হাতে আইন প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু সম্ভবত আরও কার্যকর উপায় হবে গাড়ি নির্মাতাদের উপর নজরদারি বাড়ানো, যাতে হর্নের ডেসিবেল নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং এয়ারহর্ন ও ডবল-আওয়াজের বৈদ্যুতিক হর্নগুলিকে নিষিদ্ধ করা যায়। ট্রাফিক পুলিশের খেয়ালখুশির উপর নির্ভর করতে হবে না, সরকারি পরিদর্শকরা তুলনায় সহজে এমন বিধিনিষেধ প্রয়োগ করতে পারবেন। দ্বিতীয় উপায়টি হল, প্রচার কাজ চালিয়ে যাওয়া, গাড়ি চালানোর স্কুলে সঠিক পদ্ধতির অংশ হিসেবে হর্ন-সমস্যার কথা সম্বন্ধে ভবিষ্যৎ চালকদের সচেতন ও সতর্ক করা।
ইতিমধ্যে আমাদের এক বন্ধুর কায়দা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। দু-কানে ইয়ার-প্লাগ ব্যবহার করে কিন্তু কলকাতার রাস্তায় সে ভালই আছে! |