ব্যয়সংকোচই যে দুর্গত অর্থনীতিতে বিকাশের অনুকূল পরিস্থিতি তৈয়ার করার অন্যতম উপায়, ইহা বিভিন্ন সরকার শিরোধার্য করিয়াছে। সেই সরকার যদি আবার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়, তবে তো এ ধরনের ব্যয়সঙ্কোচ সরকারের দায়বদ্ধতারও অন্তর্গত হইয়া পড়ে। তাই রুগ্ণ অর্থনীতির দেশ ইতালির প্রধানমন্ত্রী এনরিকো লেত্তা যখন তাঁহার মন্ত্রী ও আমলাদের গাড়ি-বিলাস বন্ধ করিতে ষোলোটি লিমুজিন কিংবা তিনটি ভিআইপি-বাহী বিমান বিক্রি করার সিদ্ধান্ত লন, সরকারি গাড়ির বদলে বাসে চড়িয়া (বড় জোর ট্যাক্সিতে) যাতায়াতের কথা বলেন কিংবা আইনসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য খরচ হইতে কোষাগারকে অব্যাহতি দিতে সচেষ্ট হন, তাহা স্বাভাবিক বলিয়াই মনে হয়। বস্তুত, ইতালির জনপ্রিয় কিছু দল তো প্রধানমন্ত্রীর এই নিদানকে ‘বড় অল্প হইল’ বলিয়া সমালোচনাও করিয়াছে। বিশেষত ব্যয়সংকোচের অভিযানের মধ্যেও যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে তাহার সামরিক আমলাদের ব্যবহারের জন্য ১৯টি বিলাসবহুল গাড়ি কেনার বরাত দিতে দেখা যায়।
ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক দুরবস্থা নিত্য আলোচিত। পূর্বতন সরকারের ঋণের বোঝা এবং নূতন সরকারের অপর্যাপ্ত তহবিলের ফলে রাজ্য সরকারকে যে ‘কষ্ট’ করিয়া চলিতে হইতেছে, পরিবহণমন্ত্রী এই সে দিনও জনসাধারণকে তেমন কষ্ট করার উপদেশ দিলেন। বাস-মালিকরা যাহাতে তাঁহাদের ‘শত কষ্ট সত্ত্বেও’ ভাড়া না বাড়াইয়াও বর্ধিত দামে জ্বালানি ও যন্ত্রাংশ ক্রয় করেন, সে জন্য তাঁহার কাকুতি-মিনতি চমকপ্রদ। পরিবহণমন্ত্রী নিজে কতটা কষ্ট করিতেছেন, সরকারি কোষাগার হইতে তাঁহার গাড়ির জন্য জ্বালানি কিনিতে কত খরচ হইতেছে, সে সকল প্রশ্ন উহ্য থাকুক। তবে এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের সরকারই যে একমাত্র দুষ্ট, তাহা নয়। কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার-সহ সকল রাজ্যের সরকারই জনগণের টাকা উড়াইতে সিদ্ধহস্ত।
বাজেট রচনায় অর্থমন্ত্রীরা ব্যয়সংকোচের কথা উচ্চারণ করেন, কিন্তু সরকারি কর্তাদের দৈনন্দিন আচরণে সেই নীতি কার্যকর করার কোনও ব্যবস্থা লন না। ফলে প্রায়শ মন্ত্রী ও আমলাদের জন্য নির্দিষ্ট গাড়িতে তাঁহারা সওয়ার না থাকিলেও সেগুলি শহরময় কিংবা রাজ্যময় টহল দেয়, কেনাকাটা করে, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের স্থানান্তরে লইতে ব্যবহৃত হয় এক কথায় সরকারি কাজ নয়, এমন ব্যাপারেই অধিকাংশত ব্যাপৃত থাকে এবং সরকারি ব্যয়েই তাহা করে। এমন নিয়ম-বহির্ভূত অপচয় সমবেত করিলে যে বিপুল পরিমাণ অর্থের সংকুলান হয়, তাহা নিশ্চিত ভাবেই অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করার কাজে লাগানো যায়। কিন্তু সে জন্য ইতালির মতো দৃষ্টান্ত অনুসরণের প্রয়োজন। গণতন্ত্রকে যাঁহারা গরিষ্ঠতার জোরে আত্মোন্নতির সোপান রূপে ব্যবহার করিতে উৎসুক, তাঁহারা কখনও সরকারি অর্থের অপচয় বন্ধে স্বীকৃত হইবেন না। কেননা তাঁহারা মনে করেন, সরকারি অর্থ সরকারের কাছে গচ্ছিত জনসাধারণের অর্থ নয়, জনসাধারণের দেওয়া কর বা রাজস্বের উপর জনসাধারণের কোনও অধিকার নাই, সেই অর্থে গাড়ি হাঁকাইবার বিশেষাধিকার কেবল তাঁহাদের অর্থাৎ মন্ত্রী, আমলা ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। তাই পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের শাসকরা শাসিতদের ‘ত্যাগস্বীকার’-এ আহ্বান জানাইবেন, যাহাতে সেই কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে অটুট সরকারি কোষাগার তাঁহারা খালি করিয়া যাইতে পারেন। |