|
|
|
|
বিহারে ট্রেনের ধাক্কায় মৃত ৩৭, ভাঙচুর-আগুন |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
খোল-করতালের আওয়াজ, ভক্তদের চিৎকারে চাপা পড়ে গিয়েছিল পটনাগামী রাজ্যরানি এক্সপ্রেসের হুইসেলের শব্দ। রেল লাইন ধরে মন্দিরের দিকে এগোচ্ছিলেন শ’য়ে শ’য়ে পুণ্যার্থী। তাঁদের উপরেই হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল প্রচণ্ড গতির এক্সপ্রেস ট্রেনটি। লাইন থেকে সরতে পারেননি হতচকিত বহু মানুষ। দু’পাশে দু’টি ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকায় আরও কঠিন হয়ে পড়ে সেই কাজ। এক্সপ্রেসের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩৭ জন (যদিও রেলের দাবি, মৃত্যু হয়েছে ২৮ জনের)। যাঁদের মধ্যে ১৩ জন মহিলা ও ৪ জন শিশু। গুরুতর জখম চল্লিশেরও বেশি। ফলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। |
|
রাজ্যরানি এক্সপ্রেসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে উন্মত্ত জনতা। ছবি: পিটিআই। |
সোমবার সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ উত্তর-পূর্ব বিহারের খগাড়িয়ার কাছে ধামারাঘাট স্টেশনে ঘটে এই দুর্ঘটনা। যার জেরে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। চোখের সামনে এতগুলো লোকের মৃত্যু দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে মানুষ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, স্টেশনে তখন ছিলেন ১৫-২০ হাজার মানুষ। আপৎকালীন ব্রেক কষার ফলে স্টেশন থেকে সামান্য দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল রাজ্যরানি এক্সপ্রেস। তার উপরে প্রথম চড়াও হয় উন্মত্ত কয়েক হাজার মানুষ। টেনে হিঁচড়ে নামানো হয় ট্রেনের চালকদের। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় ইঞ্জিনে। তার পরে একাধিক কামরাতেও। এর পরে জনতা আক্রমণ করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনকে। তারও ইঞ্জিন এবং কয়েকটি কামরায় ভাঙচুর করে আগুন লাগানো হয়। ভেঙে দেওয়া হয় স্টেশনের সিগন্যাল ব্যবস্থার যন্ত্রপাতিও। তাণ্ডবে ভয়ের চোটে রেলকর্মীরা স্টেশন ছেড়ে পালিয়ে যান। সিগন্যাল ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ায় সমস্তিপুর, সহর্ষ শাখায় ট্রেন চলাচল সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এলাকাটির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগও ভাল নয়। তাই দীর্ঘক্ষণ সেখানে পৌঁছতে পারেনি উদ্ধারকারী ট্রেন বা কোনও অ্যাম্বুল্যান্সও। ফলে ঘণ্টা তিনেক রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত দেহগুলি পড়ে ছিল লাইনের ধারে। পরিস্থিতি সামাল দিতেও হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে।
মৃতের সংখ্যা নিয়ে অবশ্য রেল এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে দাবির যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর দাবি, মৃতের সংখ্যা ২৮। কিন্তু পটনায় মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত মারা গিয়েছেন ৩৭ জন। রাজ্য প্রশাসন সূত্রে বলা হয়েছে, সংখ্যাটি বাড়তে পারে।
এ ভাবে লাইনের উপর দিয়ে হাঁটা যে বেআইনি, সে কথাও বলা হয়েছে রেলের তরফে। রেলের একটি অংশের বক্তব্য, ট্রেন আসার কথা ঘোষণার পরেও কেউ যদি লাইন দিয়ে হেঁটে যান, তা হলে দুর্ঘটনার দায় রেলের নয়। এ ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে পাওয়া তথ্য থেকে স্পষ্ট, ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও লাইন দিয়েই হেঁটে মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলেন পুণ্যার্থীরা। দুর্ঘটনা ঘটেছে তাঁদের অসাবধানতার ফলেই। রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান অরুণেন্দ্র কুমার জানিয়েছেন, ধামারাঘাটে ট্রেনটির দাঁড়ানোর কথা ছিল না। সে কারণেই সেটিকে সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়েছিল। লাইনের উপর ভিড় দেখতে পেয়েই চালক আপৎকালীন ব্রেক কষেন। কিন্তু ট্রেনটি থামার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে যায়। ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও সেই কারণেই তাঁরা বিবেচনা করবেন না বলে প্রাথমিক ভাবে ইঙ্গিত দেন রেল বোর্ডের কর্তারা। কিন্তু পরে সার্বিক ঘটনা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রেল মন্ত্রক এককালীন আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করে। তবে এ ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ নয়, অনুদান ঘোষণা করেছে তারা। অধীরবাবু জানিয়েছেন, মৃতদের পরিবারকে এককালীন পাঁচ লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়া হবে। জখম যাত্রীদের ক্ষেত্রেও এককালীন অনুদান এক লক্ষ টাকা। অধীরবাবু জানান, এই ঘটনায় দু’টি ট্রেন মিলিয়ে দু’টি ইঞ্জিন ও ২২টি কামরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ দিন বিকেলেই ঘটনাস্থলে রওনা দেন অধীরবাবু। |
|
লাইনের ধারে ছড়িয়ে রয়েছে মহিলা ও শিশুর দেহ। ছবি: রয়টার্স |
বিহার সরকার অবশ্য ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেছে। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার জানিয়েছেন, মৃতদের পরিবারকে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তা ছাড়া, রাজ্য সরকারের তরফেও দেড় লক্ষ টাকা করে সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি, ধামারাঘাটে রাজ্য সড়ক তৈরির পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়িত করার জন্য বিহার পূর্ত দফতরকে নির্দেশ দিয়েছেন নীতীশ।
কী ভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?
রেল এবং প্রশাসনিক সূত্রের খবর, শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার শিবের ‘জলাভিষেক’ অনুষ্ঠানে ধামারাঘাটের কাত্যায়নীস্থান মন্দিরে প্রতি বছরই ভিড় উপচে পড়ে। পূর্ব-মধ্য রেলের সহর্ষ-মানসী শাখায় ‘সিঙ্গল লাইন’ রয়েছে। দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগে স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের ‘লুপ’ লাইনে গিয়ে দাঁড়ায় সমস্তিপুর-সহর্ষ প্যাসেঞ্জার। উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল বনমুখী-সমস্তিপুর প্যাসেঞ্জার। ওই দুই লুপ-লাইনের মাঝখানে রয়েছে মেন লাইন।
রেল সূত্রের খবর, সমস্তিপুর-সহর্ষ প্যাসেঞ্জারের বেশির ভাগ যাত্রীই পুজো দিতে ধামারাঘাটে যাচ্ছিলেন। কাত্যায়নী মন্দিরটি স্টেশনের কাছেই। ওভারব্রিজে না উঠে মধ্যের লাইনটি ধরে এগোচ্ছিলেন তাঁরা। প্রার্থনা, ঢাকঢোলের আওয়াজ, মন্দিরের ঘোষণা চলছিল নাগাড়ে। সেই শব্দে সহর্ষ থেকে পটনাগামী রাজ্যরানি এক্সপ্রেসের হুইসেল শুনতে পাননি কেউই। তা ছাড়া স্টেশনে ঢোকার সাতশো মিটার আগে রেল লাইনে একটি বাঁক রয়েছে। তাই তার আগে লাইনের উপরে ভক্তদের ভিড়ও দেখতে পাননি চালক। ওই ভিড় দেখার পর ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে চলা এক্সপ্রেস ট্রেনটির চালক আপৎকালীন ব্রেক কষেন ঠিকই, কিন্তু থামতে থামতে সেই ট্রেন ভিড়ের উপরে এসে পড়ে। আর তার চাকায় পিষে যান অসহায় যাত্রীরা।
খগাড়িয়ার এসপি শিবকুমার ঝা জানান, দুর্ঘটনার পর ঘণ্টাতিনেক স্টেশন এলাকা রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল। দেহগুলি তত ক্ষণ লাইনেই পড়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়নি আহতদেরও। দুপুরে বিহার পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। তার পর রেলের ‘মেডিক্যাল ভ্যান’ ধামারাঘাট স্টেশনে ঢোকে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, দুর্ঘটনার পরপরই এক্সপ্রেস ট্রেনের দুই চালককে টেনে নামিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। গুরুতর জখম হন তাঁরা। তবে পরে তাঁদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। রেল কর্তাদের দাবি, রাজারাম পাসোয়ান এবং সুশীলকুমার সুমন নামে ওই দুই চালক এখন নিরাপদেই রয়েছেন।
রাজ্যরানি এক্সপ্রেস চালু করেছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোনও রাজ্যের রাজধানী থেকে সে রাজ্যেরই কোনও বড় শহরের সঙ্গে রেল যোগাযোগের জন্য অনেকটা ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসের ধাঁচে ওই ট্রেনের সূচনা করা হয়েছিল। সারা দেশে এমন বেশ কয়েকটি রাজ্যরানি এক্সপ্রেস রয়েছে।
|
|
|
|
|
|
|