জুনি আর কাকটা
কাকটা যথারীতি এসে বসল বারান্দার গ্রিলে। এই সকালেই কোত্থেকে কী খেয়ে এসেছে, দু’চার বার গ্রিলে ঠোঁট মুছে বলল, ‘কাল কাকে দেখলাম জানো?’
জুনি হারমোনিয়াম চাবি খুলতে খুলতে বলল, ‘আঃ, কা কা থামাও দেখি। আমাকে গলা সাধতে দাও।’
‘ভারী তো গলা সাধা! আমি বলে তাই। অন্য কাকেরা ত্রিসীমানায় থাকে না তুমি গাইলে।’
কী একটা টুক করে মুখে পুরে কাকটা খুব খানিক কাঃ কাঃ করে হেসে নিল। তার পর বলল, ‘তান যখন ধরো, তোমার ওই বুড়ো মাস্টারের মুখখানা যদি দেখতে। গাও তো চোখ বুজে। কিচ্ছু দেখতে পাও না। ভারী বিদঘুটে অভ্যাস তোমার।’
কাকটার একটু ব্যঙ্গ করার স্বভাব আছে। আজকাল জুনি আর রাগ করে না এতে। সে জুনির দিদাকে বলেছিল, ‘আপনার ঠোঁট দুটো খুব লাল। আমার মতো নয়। এত লাল যেন রঙ্গনের রং, তবে কিনা পান খেয়ে খেয়ে। এই বারান্দার কোণটাও লালে লাল।’
দিদা অবশ্য একটি কথাও বোঝেনি। কা কা শুনে বলেছিল, ‘যা হুশ! বাড়ির মধ্যে কা কা! ভারী অলক্ষুণে!’
আরে, একটা পাখি এসে ডাকছে, তার আবার অলক্ষণ কুলক্ষণ কী! দাদু অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল, ‘কী যে সব বলো তুমি শীলা! পাখি প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি। ভেবে দেখো, আকাশ আছে পাখি নেই, বসন্ত আছে কুহু রব নেই, ছাদ আছে পায়রা নেই, উঠোন আছে চড়াই শালিক নেই!’ দাদু ভাবে বিভোর। দিদা পিচিক করে বারান্দায় পিক ফেলে বলল, ‘কাকের কা কা নেই, ছাগলের ব্যা ব্যা নেই, গরুর হাম্বা নেই! মরণ! কাক আবার একটা পাখি নাকি!’
ছবি: সুমন চৌধুরী।
জুনির খুব দুঃখ হয়েছিল। একে তো গোলাপি পাথর বসানো বারান্দার কোণে পিক ফেলা হচ্ছে, তার ওপর কাকের নিন্দা! কাকটা এক দিন খুব করুণ মুখে বলেছিল, ‘জানো, মানুষ আমাদের পাখি বলেই গণ্য করে না। ঘুঘু পাখি হয়, হাঁড়িচাচা পাখি হয়, শকুন্ত পাখি হয়, বাজ পাখি হয়, কিন্তু কাকের বেলায় বলবে, কাকপক্ষী টের না পায়। যেন কাক আর পক্ষী আলাদা কুল। কী দাঁড়াল তা হলে? কাক যেন পক্ষী নয়।’
রাগ না হলেও, নিজের গানের নিন্দে শুনে জুনি বলতে যাচ্ছিল, ‘তা তোমার গলাটি কেমন? শুনতে পাও না? ক্যা ক্যা ক্যা! একটু যদি মিষ্টি হত!’ শেষ পর্যন্ত বলল না পাছে কাকটা দুঃখ পায়! মা বলে, কাউকে দুঃখ দিতে নেই। সে বলল, ‘শুনে রাখো, আমি সঙ্গীত বিশারদ থার্ড ইয়ার। পাড়ার ‘বসে গাও’ প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট।’
কাক বলল, ‘সে প্রতিযোগিতার গান আমি শুনেছি। আয় তবে সহচরী...! এমন কিছু আহামরি নয়। অন্যরা তোমার চেয়েও খারাপ, এই যা। তবে ঠাকুরদা এক জনের কথা বলত যে মাত্র সাত বছরের চেষ্টায় তার সপ্তক ষড়জে সুর লাগাতে পেরেছিল। তোমার আশা আছে।’
‘সে আমি এখনই পারি। শুনবে?’ বলে, জুনি দ্রুত সা রে গা মা পা ধা নি সা আঙুল চালিয়ে নিল। তারস্বরে ষড়জে আরোহণ করবে বলে যেই না হাঁ করেছে, কাক ভারী বিরক্ত হয়ে বাধা দিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও! কথা নেই বার্তা নেই সোজা তার সপ্তকে চড়ছ যে! গলা সাধার একটা নিয়ম-নীতি নেই নাকি?’
‘তোমাকে শোনাচ্ছিলাম আমি পারি কিনা।’
‘সে আমি খুব শুনেছি।’ একটু গলা নামিয়ে সে বলল, ‘এই, তোমার চানাচুরটা ফুরিয়ে গিয়েছে?’
‘দেখতে হবে।’
‘দারুণ খেতে কিন্তু।’
‘একটু আগেই তো কী একটা খেয়ে এলে!’
‘আরে দূর! সে এক বিশ্রী জিনিস! বাচ্চাটা চিবিয়ে ফেলল, আমিও ঠকরে দেখতে গেলাম। সেই থেকে আঠা ভাবটা ঠোঁট থেকে যাচ্ছেই না!’
‘যা পাবে তাই খাবে! হ্যাংলা কোথাকার! ওটা নিশ্চয়ই চিউয়িং গাম! কোন দিন আঠা লেগে ঠোঁট আটকে যাবে তোমার। বেশ হবে। যা ঠোঁটকাটা তুমি!’
জুনি চানাচুর আনতে গেল। কাকটা কিছুক্ষণ বেশ মনখারাপ করে বসে রইল। কথাটা সত্যি। সে একটু হ্যাংলা বটে। ইঁদুর বাদুর কথ থুতু পচা হ্যাজা কিছুই কি বাদ দেয়? কী করবে? এ তো স্বভাবগত! তবে চানাচুরের মতো সুন্দর জিনিস আর হয় না। ভাবতেই তার মন প্রসন্ন হয়ে উঠল। বারান্দার কোণের দিকে টেরিয়ে দেখল লাল ছোপ সাফ হয়েছে। দিদা ফিরে গিয়েছে কিনা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মানুষেরও থাকে কত মলিন স্বভাব। ঠোঁটের আঠা আরও কয়েক বার গ্রিলে ঘষে নিল সে। জুনি এক বাটি চানাচুর নিয়ে এল। সঙ্গে দুটো মারি বিস্কিট। আহ্লাদে একেবারে আটখানা হয়ে ডাকতে লাগল কাকটা। এত ভাল ভাল খাবার, একা খাবে না, খেতে নেই। ওটা স্বার্থপরতা। খেতে হয় দল জুটিয়ে। তিন চার জন এর মধ্যেই সামনের ওই নাগচম্পার ডাল থেকে গলা ঝুলিয়ে উঁকি মারছে।
জুনি বলল, ‘তুমি যেন কী বলছিলে? কাকে দেখেছ?’
সারাক্ষণ পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছে, কাক জানে না এমন খবর নেই। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ! গর্গনজোলাকে দেখলাম।’
‘গর্গনজোলা?’
‘আরে ছদ্মবেশী রাস্তাপপুলাস। টিনটিনের দুশমন। পশ্চিমের বড় পুকুরের ধারে ঘুরঘুর করছিল। কে জানে কী মতলব!’
কাকটা চানাচুরে মন দিল। ‘তোমার যত আজব কথা’, এই বলে জুনিও গলা সাধতে বসল। চলয়ে নন্দলালা মথুরাসে বিন্দাবন গোঠ। ত্রিতালে বাঁধা ভৈরবী রাগিণী।
আর সব কাকেরাও ভোজ সারতে এসেছে। এক জন যতখানি পারে চানাচুর মুখে পুরে বলল, ‘গলাটা মিষ্টি। চল চল। খাবার সব শেষ। অন্য কোথা যাই।’
‘তোরা যা। আমি পরে আসছি।’ বলল কাকটা। মেয়েটা সত্যি বড় ভাল গায়। গ্রিলের ওপর গুছিয়ে বসে তাল ঠুকতে লাগল সে। একদম ষোলো মাত্রা গুণে। কাকেরা চিরকাল গোনাগুনতিতে পাকা। সেই কাক্কেশ্বর কুচকুচের আমল থেকে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.