মহম্মদ আজহারউদ্দিনের ক্রিকেটার-সমাজে আনুষ্ঠানিক প্রত্যাবর্তন ঘটল দীর্ঘ তেরো বছর পর। মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে আজহার, পাশে সচিন, তার পাশে সৌরভ, একটু দূরে রাহুল। এমন একটা ফ্রেম তৈরি হতে পারে কেউ স্বপ্নে, সরি দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। সচিন-রাহুল-সৌরভ হলেন ভারতীয় ক্রিকেটে বিশ্বাসযোগ্যতার ব্রহ্মা-বিষ্ণু- মহেশ্বর। এঁদের পাশে দাঁড়ানো মানে সে যত দাগীই হোক না কেন, তার সব অপরাধ ধুয়েমুছে সাফ।
প্রত্যাবর্তনকারী আজহার অবশ্য এখনও প্রবল অভিমানী। ক্ষুব্ধ আর ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত। তিনি হতে পারেন মোরাদাবাদের সাংসদ। হতে পারে জম্মু-কাশ্মীর থেকে এ বার বোর্ডে মনোনয়ন পেতে পারেন। হতে পারে তাঁর জীবনে এখন অনেক নতুন সব হাইওয়ে। কিন্তু কোথাও ভেতরে আঘাতের যে জায়গাটা হয়েছে, সেখানে অস্ত্রোপচার করা যায়নি। আর তাই রক্ত ঝরে। নইলে কর্নাটক ক্রিকেট সংস্থা আয়োজিত পঁচাত্তর বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে মঞ্চ আরোহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে কম সময় পেয়েও কেন ঝরে পড়বে তাঁর অভিমানী অভিযোগ, “জীবনের শেষ টেস্ট খেলেছিলাম চিন্নাস্বামীতেই। আরও অনেক স্মৃতি আছে। মাঠটাকে তাই ভুলতে পারি না। আর এই মাঠ আমাকে এমন একটা রেকর্ড করিয়ে দিয়েছে যা কেউ কখনও ভাঙতে পারবে বলে মনে হয় না। সেটা হল নিরানব্বই টেস্ট ম্যাচ খেলে থেমে যাওয়ার রেকর্ড। বলছি তো, মনে হয় না আর এটা কখনও ভাঙা সম্ভব বলে।” আজহার মাইকটা ফিরিয়ে দিলেন সংযোজক চারু শর্মার হাতে। দু’হাজার দর্শক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। মঞ্চের ওপর আজহারের সহ খেলোয়াড় বা দেশের প্রাক্তন অধিনায়কেরাও চুপ। |
আজহারের প্রত্যাবর্তন
ক্লাইম্যাক্সে অন্য টেস্ট অধিনায়কদের সঙ্গে। |
সচিন তেন্ডুলকর সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ যখন স্টেডিয়ামে ঢুকলেন তখন মনেই হচ্ছিল না এটা অভিজাত ক্রিকেট-সমাজের অনুষ্ঠান। মনে হচ্ছিল ভরদুপুরে চৌরঙ্গির ওপর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একটা বিশাল শোভাযাত্রা তাঁকে ঘিরে ধরল মুহূর্তে। ঠিক তার আধ ঘণ্টা আগে ঢুকেছেন আজহার। পাশাপাশি দুটো টেবিল রাখা ছিল তাঁদের দু’জনের জন্য। আজহার নিজের জায়গাতেই বসেছেন। সচিন বসলেন দূরে। তখন থেকেই যেন অলক্ষ্যে স্থির হয়ে গেল, বরাবরের মতোই আজকের নায়কও যদি সচিন হন, অ্যান্টি-হিরো হলেন আজহার। ক্রিকেটীয় জীবনে এত কীর্তি সত্ত্বেও লোকে তাঁর ধারপাশ মাড়াতে চাইছে না। সংগঠকেরা স্টেজের ঠিক সামনে থাকা গোল টেবিলের যে তালিকা করেছিলেন, তাতে পরপর কার্ডগুলো যে ভাবে লাগানো ছিল সে অনুসারে একটায় বসার কথা সচিন, ওয়াড়েকর, বেদী, বোরডেদের। পাশেরটায় দ্রাবিড়, সৌরভ আর আজহার। এটা দেখার জন্যও সবাই কৌতুহলের সঙ্গে তাকিয়ে ছিল যে, যিনি সচিনের মতোই বিশুদ্ধবাদী, কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরও গোঁড়া, সেই রাহুল কী করেন? বসবেন তিনি আজহারের সঙ্গে গা-শোঁকাশুকি করে এক টেবিলে?
অনুষ্ঠান শুরু হতে দেখা গেল চিরকালের নিয়ম মেনে চলা দ্রাবিড় আজ সর্বপ্রথম নির্দেশ অমান্যকারীদের দলে নাম লিখিয়েছেন। আজহার তখনও ঢোকেননি। কিন্তু তিনি চলে গেলেন পেছনে, দুটো সারি পরে। আর সেই জায়গা থেকে নড়লেন না। সচিন-সৌরভ দু’জনে একসঙ্গে ঢুকে বসে পড়ার পর খেয়াল করেন বাঁ দিকে রিচার্ড হ্যাডলি রয়েছেন। তাঁরা উঠে যান হ্যাডলির সঙ্গে হাত মেলাতে। হ্যাডলির পাশে গিয়ে আবিষ্কার করেন ওখানে আজহার বসা। তখন তাঁর সঙ্গেও পোশাকি হাত মেলান সচিন-সৌরভ। আজহার দ্রুত দাঁড়িয়ে উঠে সচিনকে জড়িয়ে ধরেন। সচিন সেই বাউন্সার কোনও রকমে সামলে ফিরে গেলেন নিজের চেয়ারে। এর পর মঞ্চে একে একে সচিন- সৌরভ-রাহুলদের ডাকা হচ্ছে। কিন্তু আজহারের নাম উচ্চারণও কেউ করছে না। তখন মনে হচ্ছিল কর্নাটক ক্রিকেট সংস্থাও কি অস্বস্তি এড়াতে আজহারকে স্রেফ নিয়মরক্ষার নেমন্তন্ন করেছে? |
সচিনকে ‘বাউন্সার’ |
অবশেষে পাশাপাশি |
|
ক্রিকেটার হয়েও মহাতারকাখচিত এমন অনুষ্ঠান যে ভাবে পরিচালনা করলেন কুম্বলেরা, তা যে কোনও রাজ্য সংস্থার কাছেই দৃষ্টান্ত হতে পারে। কে বলবে, মাঠের বাইরে কুম্বলেদের অন্য একটা টেনশন চলছিল ক’দিন ধরে। তাদের কোনও এক সদস্য কর্নাটক হাইকোর্টে চলে গিয়েছিলেন এই অনুষ্ঠান বন্ধ করার লক্ষ্যে। তাঁর অভিযোগ ছিল, অনিল কুম্বলে বৈধ প্রেসিডেন্টই নন। বোর্ডের নিয়মে আছে অবসর নেওয়ার পর দু’বছর কাটালে তবে সে রাজ্য সংস্থার পদে আসতে পারবে। কুম্বলে তবু আসতে পেরেছিলেন কারণ খসড়া আইনের একটা সংশোধন করা হয়েছিল দেশের হয়ে একশো টেস্ট ম্যাচ খেললে তার দু’বছর অপেক্ষা করার প্রয়োজন হবে না। ব্রিজেশ পটেলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রেজিস্ট্রার অব কোঅপারেটিভ সোসাইটির কাছে খসড়া পাঠিয়ে আইনকে সংশোধন করে নেওয়ার। হাইকোর্টের কাছে স্থগিতাদেশের আবেদন আসায় কুম্বলেরা প্রথম জানতে পারেন যে, ব্রিজেশ পটেল রেজিস্ট্রারের কাছে ওটা পাঠানইনি। তাঁদের ধারণা হয় বিরোধী পক্ষ হয়ে এখন তিনিই কলকাঠি নাড়ছেন। কুম্বলে তখন সিদ্ধান্ত নেন কোর্ট যদি তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দেয়, তিনি শনিবারের এই অনুষ্ঠান পরিচালন করবেন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে। কোনও রকমে তাঁরা সেরা আইনজীবীদের লাগিয়ে এ যাত্রা প্লেড-অন হওয়া বাঁচিয়েছেন। মামলার শুনানি উঠবে আবার মঙ্গলবার। ব্রিজেশ এখন এঁদের বিরোধী পক্ষ। নেমন্তন্ন পেয়েও এ দিনের অনুষ্ঠানে আসেননি। স্থানীয় মিডিয়া এবং ক্রিকেটমহলের ধারণা ছিল, আবার না কোনও ধূর্ত চালে এ দিনের অনুষ্ঠান সমস্যায় পড়ে যায়। কুম্বলে শ্রীনাথরা তাই আগাগোড়াই খুব টেনশন আক্রান্ত ছিলেন। |
শ্রীকান্তের পিছনে যেন ‘মার্শাল’ |
কিন্তু এটা একান্তই কর্নাটকের চোরা সমস্যা। বাইরের লোক অত বোঝেনি। তারা মন দিয়ে আজহার-সচিন নাটকই দেখছিল। তারা দেখল যে রাহুল-সৌরভ খুব সযত্নে তাঁদের প্রাক্তন প্রথম অধিনায়ককে এড়িয়ে গেলেন। সত্যি বলতে কী, আজহারও তাঁদের দিকে ততটা মন দেননি। তাঁর যেন বেশি লক্ষ্য ছিল সচিনের সঙ্গে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করা। সচিন-সৌরভরা ছোট চ্যাট শো শেষে মঞ্চ থেকে নেমে আবিষ্কার করলেন, আজহার তাঁদের জায়গাটায় বসে গিয়েছেন। সৌরভকে সেই সময় মঞ্চে ডেকে নেওয়া হল। কুম্বলেদের সংস্থা এ দিন তাঁকে খুব খাতির করল। চন্দ্রশেখর-প্রসন্নদের হাতে পুরস্কার দেওয়াল। জাভাগল শ্রীনাথ মঞ্চে বললেন, “আমার ক্রিকেটজীবনের সেরা দুটো মুহূর্ত হল সচিনের পারথে সেঞ্চুরি আর গাঙ্গুলির অধিনায়কত্ব।” কিন্তু প্রশংসা করলে কী হবে, সৌরভ সেই সময় টানা অতক্ষণ মঞ্চে থাকায় তাঁর ‘ছোটবাবু’ একলা হয়ে গেলেন। আজহার তখন ডান দিকে সরে এসেছেন। দু’জনের মাঝখানে শুধু কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত
দেশপ্রেম আজাদের শেষকৃত্যে যাওয়ার জন্য কপিল দেব আসতে পারলেন না। শ্রীনিবাসনও এলেন না সম্ভবত বিতর্ক এড়াতে। তবু চিন্নাস্বামী যা দেখল, তা তার বাইশ গজে অভিনীত মহানাটকের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। টি-টোয়েন্টি ম্যাচের মতো পরিস্থিতি মিনিটে মিনিটে বদলাল। আর শেষে এমন একটা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছল যা কেউ কখনও ভাবতে পারেনি! |
জম্মু ও কাশ্মীর ক্রিকেট সংস্থা তাদের দলের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দিল মহম্মদ আজহারউদ্দিনকে। কিন্তু ভারতীয় বোর্ড তাঁকে এই দায়িত্ব নেওয়ার অনুমতি দেবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। আজহারের বিরুদ্ধে গড়াপেটার অভিযোগ ওঠায় তাঁকে যে চিরনির্বাসন দিয়েছিল বোর্ড, গত বছর অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্ট তাকে বেআইনি আখ্যা দিলেও, তার বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে বোর্ড। |