প্রায় ৩০০ বছরের স্মৃতি খুঁড়ে বন-শহিদের স্বীকৃতি
স্বীকৃতি জুটল, তবে প্রায় পৌনে তিনশো বছর পরে।
১৭৩০ সালে, রাজস্থানের খেজরালি গ্রামে, ভাদ্রের এক দুপুরে রাজ-কাঠুরেদের হাত থেকে বন বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন ৩৬৩ জন বিশনোই সম্প্রদায়ের মানুষ। দিনটা ছিল ১১ সেপ্টেম্বর।
স্বাধীনতার পরে, বন ও পরিবেশ বিষয়ক একটি পৃথক মন্ত্রক গঠন করা হয়। দাবি উঠেছিল তখন থেকেই, বন রক্ষার্থে প্রাণ দিয়েছেন যে সব বনকর্মী তাঁদের স্মৃতিতে একটি দিবস ঘোষণা করা হোক। দীর্ঘ দিনের সেই দাবি মেনে শেষ পর্যন্ত বন-শহিদ দিবস ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিল বন মন্ত্রক। এবং বেছে নিল সেই ১১ সেপ্টেম্বরকেই।
কেন্দ্রীয় বন মন্ত্রকের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (আরটি) ডি কে শর্মা জানান, এখন থেকে ১১ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় বন-শহিদ দিবস’ হিসেবে পালিত হবে। তিনি বলেন, “ইতিমধ্যেই দেশের প্রতিটি রাজ্যের মুখ্য সচিবের কাছে এই বার্তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।” ‘সর্বভারতীয় বন কর্মচারী ফেডারেশন’-এর উদ্যোগে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর সল্টলেকের বিদুৎ ভবনে জাতীয় বন-শহিদ দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে উপস্থিত থাকার কথা কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রী জয়ন্তী নটরাজনেরও।
ফেডারেশনের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি অমল সিংহ জানান, জাতীয় বন-শহিদ দিবস ঘোষণার সিদ্ধান্ত হলেও কোন দিনটিকে বেছে নেওয়া হবে তা নিয়ে দ্বিধায় ছিল বনমন্ত্রক। ১১ সেপ্টেম্বরের তাৎপর্য মেনে নিয়ে ফেডারেশনের দাবিতে ওই দিনটিকেই বেছেছে বন মন্ত্রক।
শুষ্ক, মরুময়, বছরভর জলকষ্টে ভোগা রাজস্থানের জোধপুর এলাকার মাড়ওয়াড় প্রদেশের খেজরালি ও তার আশপাশের এলাকায় তাও কিঞ্চিৎ গাছ-গাছালি ছিল। খেজরি (প্রসোপিস সিনেরারিয়া) গাছের জঙ্গলে ছাওয়া ওই এলাকায় বসবাস বিশনোই সম্প্রদায়ের। রুখু জমিতে দীর্ঘ হলুদ ঘাস-জঙ্গল আর মাঝে মধ্যে খেজরি গাছের সারি। বনের ছায়ায় রাজস্থানের পরিচিত মরূদ্যান হয়ে উঠেছিল খেজরালি। ১৭২৬ সালে জোধপুরের মহারাজা সেই খেজরালি এস্টেটের মুখিয়া করেছিলেন ঠাকুর সুরাট সিংহকে। তাঁর তত্ত্বাবধানে জঙ্গলের বাড়বৃদ্ধিও ঘটেছিল বেশ।
এই অবস্থায়, ১৭৩০ সালে মহারাজা অভয় সিংহ তাঁর প্রাসাদ সম্প্রসারণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। কিন্তু প্রাসাদ নির্মাণের জন্য প্রয়োজন চুনা পাথরের। আর সেই পাথর গলানোর জন্য প্রয়োজন জ্বালানি। পারিষদেরা উপায় বাতলালেন, খেজরির জঙ্গল থেকে কাঠ নিয়ে আসা হোক। লোকলস্কর, সেনা, নিয়ে রাজ-কাঠুরেরা ছুটল সেই বনে। কিন্তু জঙ্গলের গাছকে বিশনোই সম্প্রদায়ের মানুষ তো তাদের সন্তান হিসেবে দেখে। রাজ-কাঠুরেরা জঙ্গলে পা দিতেই তাই খেজরি গ্রামের অমৃতাদেবী বেনিওয়াল ছুটে গিয়েছিলেন বৃক্ষ-নিধন রুখতে। রাজসেনারা তাঁকে সরিয়ে দিলেও নাছোড় অমৃতাদেবী ফের ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন একটি খেজরি গাছ। রাজস্থানের লোকগীতিতে এখনও ভেসে বেড়ায় তাঁর সেই উক্তি, ‘এক জনের প্রাণ দিয়ে যদি বন বাঁচে, তবে তাই হোক’। এর পর কাঠুরেরা আর দেরি করেনি। ওই মহিলার উপরেই কুড়ুল চালিয়ে শুরু হয় গাছ কাটা। দিনটা ছিল ১১ সেপ্টেম্বর।
বন বাঁচাতে মায়ের আত্মদান দেখে অমৃতাদেবীর তিন মেয়ে, আশু, রত্নি, ভাগুও দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল গাছ। কুড়ুলের ঘা নেমে আসে তাদের উপরেও। জঙ্গল বাঁচাতে মা-মেয়েদের এই পরিণতি দেখে এর পরে আশপাশের ৮৩টি গ্রামের মানুষ একই ভাবে এগিয়ে আসে বন-বাঁচাতে। তবে মহারাজার আজ্ঞা পালনে অটল রাজ-কাঠুরেরা নিরীহ গ্রামবাসীদেরও একই ভাবে গাছের গুঁড়ির মতোই ছিন্ন করে দেয়। রক্তে ভিজে যায় খেজরির জঙ্গল। একে একে প্রাণ হারান ৩৬৩ জন গ্রামবাসী।
খবর পেয়ে মহারাজা অভয় সিংহ শোকে ভেঙে পড়েন। বোধোদয় হয় তাঁর। প্রাসাদ নির্মাণ অসম্পূর্ণ রেখেই তিনি ঘোষণা করেন খেজরির জঙ্গলে শুধু গাছ-কাটা নয়, বন্যপ্রাণের কোনও ক্ষতিও দণ্ডনীয় অপরাধ।
এ রাজ্যের জল-জঙ্গলেও গত কয়েক বছরে, কখনও বন্যপশুর থাবায়, কখনও বা চোরাশিকারিদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন বহু বনকর্মী। বছর দু’য়েক আগে সুকনার জঙ্গলে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যান কারজিমান ছেত্রী। ২০১০-এ বন্ধন ওঁরাও মারা যান চোরাশিকারিদের গুলিতে। ওই বছরই বৈকণ্ঠপুরের জঙ্গলে তিস্তায় ভেসে যাওয়া একটি হরিণ শাবককে উদ্ধার করতে গিয়ে তলিয়ে যান কালুকান্ত রায় নামে এক বনকর্মী। সেই তালিকায় শেষ সংযোজন রতন দে। এ বছরই জানুয়ারি মাসে বক্সায় একটি বন্য পশুকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁর।
১১ সেপ্টেম্বর তাঁদেরও স্মরণ করার দিন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.