প্রদীপের নীচে অন্ধকার!
এক দিকে ঝাঁ চকচকে কেন্দ্র। আর অন্য দিকে রুগ্ন শিশুর চিকিৎসার ন্যূনতম সংস্থানটুকুও না থাকা। এই পুরনো ছবিই এখনও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত জুড়ে।
রাজ্যে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে কলকাতা তো বটেই, বিভিন্ন জেলাতেও একের পর এক সিক নিউ বর্ন ইউনিট (এসএনসিইউ) চালু করেছে স্বাস্থ্য দফতর। এখনও পর্যন্ত মোট ২৫টি এমন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। কিন্তু তার পরেও কলকাতা এবং বিভিন্ন জেলায় শিশু চিকিৎসার পরিকাঠামো খতিয়ে দেখতে গিয়ে যে ছবিটা সামনে এসেছে তাতে নজরে পড়ার মতো কোনও ‘পরিবর্তন’ নেই। এসএনসিইউ-এর সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই পর্যন্ত পৌঁছনোর সাধ্যই নেই অনেকের। গ্রাম বা মহকুমা স্তরের পরিকাঠামো এখনও অন্ধকারেই।
ইতিহাস গড়ে নিজেই থমকে গিয়েছে ‘পুরুলিয়া মডেল’! কয়েক কোটি টাকা খরচের পরেও পূর্ণাঙ্গ চেহারা নিতে পারেনি ঝাড়গ্রাম এসএনসিইউ। ধুঁকছে বহরমপুর, মালদহ। কলকাতায় ছবিটা তুলনায় উজ্জ্বল হলেও বিপুল চাপের তুলনায় তা এখনও যথেষ্ট নয়।
রাজ্যে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে পুরুলিয়ার দেবেন মাহাতো হাসপাতালে নবজাতক চিকিৎসার যে কেন্দ্রটি গড়ে উঠেছিল, তা এখন বেশ কয়েকটি রাজ্য, এমনকী প্রতিবেশী রাষ্ট্রেও একটি ‘মডেল’। জেলা স্তরে আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তুলে কীভাবে রুগ্ন ও কম ওজনের নবজাতককে বাঁচানো যায়, তার নজির তৈরি করেই ‘মডেল’ হয়েছিল কেন্দ্রটি। কিন্তু পরবর্তী ধাপে সেই ‘পুরুলিয়া মডেল’-কে সামনে রেখে অন্য রাজ্য যখন পরিকাঠামোগত দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এই কেন্দ্রের কাজকর্ম থমকে রয়েছে সেই পুরনো জায়গাতেই। শয্যা বাড়েনি, একে একে বেশ কিছু যন্ত্র খারাপ হয়েছে। মেরামতির ব্যবস্থা হয়নি। আসেনি নতুন, আধুনিক কোনও সরঞ্জাম। চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসক-নার্সও নেই।
যমজ সন্তানকে নিয়ে হুড়া থেকে এসেছিলেন সুন্দরী কিস্কু। তাঁর দুটি সন্তানেরই ওজন ছিল ১২০০ গ্রাম। পুরুলিয়ার এসএনসিইউ-এ একটির ঠাঁই হয়েছিল। সে বেঁচে যায়। অপর বাচ্চাটির শয্যা পাওয়া যায়নি। সে মারা যায়।
সুন্দরীর ওই শিসু সন্তানের মতোই পুরুলিয়ার বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে ঘরে ঘরে যে রুগ্ন শিশুদের খোঁজ মিলল তাদেরও কোনও চিকিৎসা হয় না। জ্বর হলেও ওঝা ডাকা হয় বহু ক্ষেত্রেই। বেশি বাড়াবাড়ি হলে কবিরাজ। ব্যস, ওই পর্যন্তই। পরিকাঠামো বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেই আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগছে স্বাস্থ্য দফতর।
একই অবস্থা বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাঁকুড়ার খাতরা, মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার একাধিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঘুরে যে ছবি নজরে এসেছে, তা খুবই ম্লান।
পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনী গ্রামীণ হাসপাতালে গড়ে প্রতি দিন তিন-চারটি করে প্রসব হয়। রুগ্ন শিশুদের চিকিৎসার জন্য একটা ওয়ার্ড তৈরি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা অকেজো পড়ে রয়েছে। তাই প্রসূতি ওয়ার্ডেই রুগ্ন শিশুরা থাকে। ভিতরে ঢুকতেই ভ্যাপসা গন্ধে কয়েক পা পিছিয়ে আসতে হয়। ওয়ার্ডটি নিয়মিত পরিষ্কার হয় না। অথচ এই হাসপাতালেই সিক নিউ বর্ন স্টেবিলাইজেশন ইউনিট (এসএনএসইউ) খোলার কথা ঘোষণা করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। তার কী অবস্থা? হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সরা জানালেন, তাঁরা এ ব্যাপারে পুরোপুরি অন্ধকারে। ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য আধিকারিক স্বদেশরঞ্জন মাইতি বললেন, “কিছু দামী যন্ত্র এসেছে ঠিকই। কিন্তু সে গুলো চালানোর লোক নেই। তাই বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে।”
রাজ্যের মানচিত্রে পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড় এখন অনেকের কাছেই আলাদাভাবে চিহ্নিত। বহু না পাওয়া আর বঞ্চনার সাক্ষী লালগড় এবং তার আশপাশের মানুষের অন্তত ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু মেটানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কিন্তু লালগড়ের ছবিটা যে এক চুলও বদলায়নি তা মালুম হয় লালগড় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঢুকলেই। চিকিৎসার কোনও পরিকাঠামোই নেই। স্রেফ সাধারণ জ্বর আর পেট খারাপ ছাড়া আর কিছুরই চিকিৎসা হয় না। রুগ্ন শিশু এলে স্যালাইন চালানো ছাড়া আর কিছু করার ব্যবস্থা নেই। নদী পেরিয়ে ১৪ কিলোমিটার দূরের বিনপুরে রেফার করা হয় ধুঁকতে থাকা বাচ্চাগুলোকে। বহু ক্ষেত্রে যাতায়াতের পথেই তাদের মৃত্যু হয়।
ঝাড়গ্রামের এসএনসিইউ চেহারায় পাল্লা দিতে পারে যে কোনও বড় বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে। রয়েছে আধুনিক সরঞ্জাম, রয়েছেন একনিষ্ঠ চিকিৎসক, নাসর্রা। কিন্তু ট্র্যাজেডি হল, কোটি টাকার পরিকাঠামো কাজে লাগছে না কয়েক শো টাকার খরচ বাঁচাতে গিয়ে। এসএনসিইউ-এর প্রাথমিক শর্তই হল পরিচ্ছন্নতা। যে কোনও শিশুকে প্রতি বার স্পর্শ করার আগে ভালভাবে হাত ধোওয়া আবশিক্য। আবশ্যিক দফায় দফায় ওয়ার্ডটি সাফসুতরো রাখাও। শুনতে আবাক লাগলেও এটা সত্যি যে কিন্তু এ জন্য যে পরিমাণ সাবান প্রয়োজন হয় তা পান না চিকিৎসক, নার্সরা। কেন? হাসপাতালের স্টোরের কর্মীরা জানালেন, ওই খাতে পর্যাপ্ত টাকা আসে না। ওয়ার্ডের এক চিকিৎসক বলেন, “গোড়ায় নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে আমরা সাবান, বালতি, ঝাঁটা কিনতাম। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি।”
শিশু মৃত্যুর হার কমাতে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিলেন মমতা। সেই ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, “এত বছর কিছুই হয়নি। এখন ধাপে ধাপে কাজ শুরু হয়েছে। গোড়ায় কিছু ত্রুটি থাকছে। অচিরেই তা দূর হবে।” |