ডাকঘর
 
ইতিহাসের বিকৃতি
গত ২৭ জুলাই প্রকাশিত সৈয়দা হুসনা জা লিখিত ‘নিমকহারাম দেউড়ি’ শীর্ষক পত্রে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটেছে। ১৭৫৭ সালের ২৪ জুন সিরাজ তাঁর পত্মী লুৎফুন্নেসাকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে পলায়ন করতে বাধ্য হন। সাধের মনোরম হীরাঝিল প্রাসাদ মিরজাফরের হস্তগত হয়। এখানেই সম্পন্ন হয় মিরজাফরের রাজ্যাভিষেক। ক্লাইভ মিরজাফরকে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে আসীন করেন। পর্যুদস্ত সিরাজ পালিয়ে গিয়ে প্রথমে ভগবানগোলা পৌঁছন। সেখান থেকে নৌকা যোগে রাজমহল, তারপর মালদহের অদূরে জনৈক মুসলিম ফকিরের আতিথ্য নেন। পলায়নের এক সপ্তাহ পরে মিরজাফরের অনুচরবৃন্দ সিরাজকে ধরে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসেন। জাফরাগঞ্জে মিরজাফরের প্রাসাদ সৌধতলে সিরাজকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়। সিরাজের অন্নদাস, নবাব আলিবর্দির ক্রীতদাস নিমকহারম মহম্মদী বেগের তরবারি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতি সিরাজের দেহ খণ্ড বিখণ্ড করে। দেহখণ্ড বস্তাবন্দি করে হাতির পিঠে চাপিয়ে পৈশাচিক আনন্দে সিরাজের প্রতিপক্ষ বাহিনী নগর পরিক্রমা করেন। তারপর সিরাজের খণ্ড বিখণ্ড দেহকে সমাধিস্থ করা হয়। যে সৌধতলে সিরাজকে হতা করা হয়েছিল, মিরজাফরের সেই বাসভবন আজও ‘নিমকহারাম দেউড়ি’ নামে সবার কাছেই চিহ্নিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য মিরজাফর আলিবর্দির গৃহে প্রতিপালিত হয়ে ছিলেন। আর উমি চাঁদ, রায় দুর্লভ ও জগৎ শেঠকে ইতিহাস কখনও ‘নিমক হালাল’ বলে আখ্যা দেয়নি। পত্রলেখিকা প্রশ্ন রেখেছেন মিরজাফর যদি সত্যিই নিমকহারাম ও বিশ্বাসঘাতক ছিলেন তবে কেন তাঁকে এক বছরের মধ্যে পদচ্যুত হতে হল? মিরজাফরের পুত্র মিরণ অত্যাচারী হয়ে উঠলে চারিদিকে হিংসা ও আশান্তির আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আবার পুত্র মিরণের আকস্মিক মৃত্যু মিরজাফর মেনে নিতে না পেরে শোকাচ্ছন্ন ও বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে পড়েন। রাজ্যে আরও অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়। ব্রিটিশ গভর্নর ভ্যান্সিটার্ট মিরজাফরকে অনুরোধ করেন, মিরকাশিমের সহকারী নবাব হিসাবে কাজ করতে। মিরজাফর সম্মত না হলে ব্রিটিশ শক্তি গায়ের জোরে তাঁকে পদচ্যুত করে তাঁরই জামাতা মিরকাশিমকে (১৭৬০-৬৩) সিংহাসনে আসীন করেন। বাণিজ্য শুল্ক-সহ বিভিন্ন বিষয়ে মিরকাশিমের সঙ্গে ইংরেজদের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়। তখন তাঁকে সরিয়ে নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে মিরজাফরকে দ্বিতীয় বারের জন্য মসনদে (১৭৬৩-৬৫) আসীন করা হয়। হুসনা জা মিরণের মৃত্যুতে ক্লাইভের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলেন কি করে তা বুঝতে পারলাম না। আলিগহর বিহার আক্রমণ করলে মিরণ ব্রিটিশ সৈন্য-সহ যুদ্ধ যাত্রা করেন। যুদ্ধে আলিগহর পরাজিত হয়ে বিতাড়িত হন। যুদ্ধ শিবিরে থাকাকালীন আকস্মিক বজ্রাঘাতে মিরণ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। হুসনা জা-র মতে, তবে কি বজ্রপাতও ষড়যন্ত্র?
বিশ্বাসঘাতক কে?
গত ২৭ জুলাই প্রকাশিত সৈয়দা হুসনা জা লিখিত ‘নিমকহারাম দেউড়ি’ শীর্ষক পত্রের প্রেক্ষিতে এই পত্র। এ কথা সত্য যে, সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন মিরজাফর। পাশাপাশি এটাও অপ্রিয় সত্য যে, সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করায় ষড়যন্ত্রী হিসাবে অনেকে থাকলেও একা মিরজাফরকেই ‘বেইমান’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মিরজাফর নামটাই হয়ে উঠেছে একটি প্রতীক। তিনি হয়ে উঠেছেন সুবে বাংলার মানুষের কাছে একটি ঘৃণ্য চরিত্র। সেই ঘৃণার উত্তরাধিকার আজও বহন করে চলেছেন তাঁর উত্তর-পুরুষরা। সিরাজের পতন চেয়েছিলেন তাঁর অধস্তন হিন্দু রাজা ও রানিদের প্রায় প্রত্যেকে। রাজনৈতিক স্বার্থেই এই চাওয়াতে কিছুটা গতি সঞ্চার করেছিল সিরাজের অসহিষ্ণুতা ও অহমিকা। পাশাপাশি মিরজাফরের মধ্যে ছিল প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দীঘর্র্ দিন এই এলাকায় ব্যবসা করার সুবাদে এই হাঁড়ির খবর রাখত। ইতিপূর্বে সিরাজ তাঁদের ব্যবসায়িক স্বার্থে আঘাত করায় তাঁরাও সিরাজকে অপসারণের সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ওই সবের যোগফলই হল সেই ষড়যন্ত্র। যার নিটফল পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়। রেজা আলি খান তাঁর গ্রন্থে মিরজাফরের পক্ষে সাফাই দিতে গিয়ে বলেছেন যে, মিরজাফর যেহেতু আদতে ইরানের মানুষ, তাই তাঁর বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহী’ কথাটা খাটে না। দ্বিতীয়ত তিনি পদে পদে সিরাজের কাছে অপদস্থ হতেন। প্রশ্ন হল অপদস্থ হওয়াটাই কি তাঁর সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার একমাত্র কারণ? আসলে ব্যক্তিগত ক্ষোভ নয়, বাক্তিগত লাভের অঙ্কই ছিল তাঁর কাছে মূল বিবেচ্য। হুসনা জা প্রশ্ন তুলেছেন মিরজাফর যদি বিশ্বাসঘাতকই হবেন তবে এক বছরের মধ্যে কেন তাঁকে পদচ্যুত হতে হবে? ইতিহাসের একজন সাধারণ ছাত্রও জানে এর উত্তরটা। মসনদের খোয়াবে আত্মহারা মির জাফর ভেবে দেখেননি সিংহাসন প্রাপ্তির বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি মতো কোম্পানিকে উৎকোচ দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর আছে কিনা। পরবর্তীতে এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই সংঘাত শুরু হলে তিনি পদচ্যুত হন। হুসনা জা মিরণের অকাল মৃত্যু নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ষড়যন্ত্রীরা কাজ হাসিল হলে নিজস্বার্থে একে অপরকে সরিয়ে দিয়েছেন এ নিদর্শন তো ভুরি ভুরি। মিরজাফর বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না, এ কথা বললে সত্যের অপলাপ করা হবে। কিন্তু এ রকম বিশ্বাসঘাতকতার নজির ইতিহাসে অনেক থাকলেও একা মিরজাফরকেই বলির পাঁঠা করে গুরু দণ্ড দেওয়া হয়েছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.