ব্যাগ গুছিয়ে...
তিন সাগরের পারে
নারকেল গাছের সারি, কলাবাগান, কাজু বাদামের গাছ আর মনোরম বাড়িগুলোকে পেছনে ফেলে তিরুঅনন্তপুরম থেকে এগিয়ে চলেছি ভারতের দক্ষিণ প্রান্তের শেষ বিন্দু কন্যাকুমারীর দিকে।
বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর ও আরবসাগরে ঘেরা এই প্রাচীন সুন্দর শহরটি। কুমারী আম্মান মন্দির ও বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল এখানকার প্রধান আকর্ষণ। আর সেই আকর্ষণেই ছুটে চলা।
কন্যাকুমারী থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে হঠাৎ বাস থামল। সুচিন্দ্রমে থানুমালায়ন মন্দির দর্শনের জন্য। বেশ বড় মন্দির। এখানে একই লিঙ্গে ত্রি-মূর্তির অবস্থানব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। আর আছে ১৮ ফুট উঁচু হনুমানের মূর্তি। মন্দিরের পাথরের তৈরি স্তম্ভের গায়ে আঘাত করলে আজও অদ্ভুত সুরেলা শব্দ শোনা যায়। এগিয়ে চলেছে বাস। বেলা বাড়ল, কিন্তু সূর্যের দেখা নেই। ৬ কিলোমিটার চলার পরে বাস আবার দাঁড়াল। ১৮ শতকে রাজা মার্তণ্ড ভার্মার তৈরি দুর্গ ভাট্টাকোট্টাই দেখার জন্য। আবার এগিয়ে চলা গম্তব্যের দিকে। আগে থেকে হোটেল বুক করা ছিল। পৌঁছেই দলপতির জিম্মায় লাগেজ রেখে ট্রেনের টিকিটের খোঁজ নিতে যাওয়া। বেরিয়ে এসে চোখে পড়ল বিশাল লাইন। লাইন শেষের মুখে টিকিট কাউন্টারের কাছে একটা ছোট লাইন। স্পেশ্যাল টিকিট ১৫০ টাকা। আর ৩০ টাকায় সাধারণ টিকিট। মঙ্গলবার বাদে প্রতি দিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টে পর্যন্ত লঞ্চ চলে।
সারা দিন খেয়ালি মেঘের ওড়না জড়িয়ে নীল আকাশটা মুখ ঢেকেছে। হাতে মাত্র একটা দিন। যদি বৃষ্টি নামে! এমনিতে বেলা বেড়ে যাচ্ছে। পিক সিজনে, বেশ ভিড়। ফেরিঘাটে দাঁড়িয়ে থাকার পর তিন নম্বর লঞ্চে সুযোগ পাওয়া গেল। লঞ্চ ভর্তি। কিছুক্ষণ পরে ঢেউয়ে দুলতে দুলতে পৌঁছে গেলাম অভীষ্ট স্থানে। রক টেম্পলের প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। সাগরের মধ্যে বড় শিলাখণ্ডের উপর গড়ে উঠেছে অনিন্দ্যসুন্দর এই মন্দির। প্রথমে কয়েক ধাপ সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশে কালো পাথরের হাতি শোভা পাচ্ছে। উপরে মূল মন্দিরে বেদির ওপর স্বামী বিবেকানন্দের দণ্ডায়মান মূর্তি। নেমে এসে প্রশস্ত চাতালে দাঁড়িয়ে তিন সাগরের তরঙ্গায়িত রূপ দেখছিলাম। ১৮৯২-র ২৫-২৭ ডিসেম্বর এক বাঙালি পরিব্রাজক সন্ন্যাসী এখানে ধ্যান করেছিলেন। তিন সাগরের রং আলাদা করার চেষ্টা করি। তাদের জিজ্ঞেস করি, তিনের সহাবস্থান তোমাদের কেমন লাগে? শিলাখণ্ডে আছড়ে পড়া জলরাশির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। মেঘলা আকাশ থেকে কয়েক বিন্দু বৃষ্টির গুঁড়ো এসে পড়ল তখনই। শাটারে ক্লিক।
চলে এলাম নীচে মেডিটেশন হলে। শব্দহীন আলোআঁধারিতে ধ্যানগম্ভীর পরিবেশ। শুধু ওম্ চিহ্ন থেকে ওঙ্কারধ্বনি বেজে চলেছে। উঠতে ইচ্ছে করে না। বুকস্টল থেকে কয়েকটি বই কিনে চলে এলাম ওই শিলাখণ্ডের অপর দিকের শ্রীপদমণ্ডপম্ মন্দিরে। এখানে কাচের আধারে রক্ষিত আছে দেবী কন্যাকুমারীর পদচিহ্ন। ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। খুবই কাছে সাগরের ওপর লাগোয়া অন্য একটি পাথরে ১৩৩ ফুট উঁচু বিখ্যাত তামিল সন্ত কবি থিরুভাল্লুভারের মূর্তি। ফিরতি লঞ্চ পৌঁছে দিল ভারতের প্রান্তভূমিতে। তবে মন পড়ে রইল শিলাখণ্ডে।
ইতিমধ্যে বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় সাগরবেলায় দর্শন করলাম কুমারী আম্মান মন্দির। মন্দিরটি সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এখানে বিরাজ করছেন দেবী কন্যাকুমারী বা দুর্গা। উল্লেখ্য, এই মন্দিরে পুরুষদের খালি গায়ে প্রবেশ বাধ্যতামূলক।
কাছে সাগরতীরে গাঁধী মেমোরিয়াল বা গাঁধী মণ্ডপম। তাঁর চিতাভস্মের আধারটি এখানে সুরক্ষিত আছে। গাঁধীজির চিতাভস্ম এই তিনসাগরে বিসর্জন দেওয়া হয়। ভেতরে রয়েছে গাঁধী মূর্তি। কাছেই বিবেকানন্দ সংগ্রহশালা ও সরকারি মিউজিয়াম।
পরের দিন যখন বেরোলাম, পুব আকাশে গেরুয়া ছড়িয়ে পড়েছে।

ছবি: তপন দাশ
কী ভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে কন্যাকুমারী এক্সপ্রেসে নাগেরকয়েল। শালিমার থেকে গুরুদেব এক্সপ্রেস-এ যাওয়া যায়।
ওখান থেকে বাসে আধ ঘণ্টায় কন্যাকুমারী। চেন্নাই থেকে নিয়মিত ট্রেন চলাচল করে।
কখন যাবেন
সারা বছর যাওয়া যায়। ভাল সময় এপ্রিল থেকে জুন ও ডিসেম্বর-জানুয়ারি।
কোথায় থাকবেন
ইস্ট ও সাউথ কার স্ট্রিটে অনেক বেসরকারি হোটেল। টিটিডিসি-র হোটেলটি লাইটহাউস মেন রোডে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.