ফের মোটরবাইকে ধাওয়া করে এসে রাস্তায় গুলি করে মারা হল এক তৃণমূল নেতাকে।
এ বারও কাঠগড়ায় শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এবং এ বারও জড়িয়ে গিয়েছে তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামীদের নাম। এ বার অবশ্য তাঁর নিজের জেলা বীরভূম নয়। কিন্তু শুক্রবার পাশের জেলা বর্ধমানের যে এলাকার নেতা খুন হয়েছেন, সেই মঙ্গলকোটের দলীয় পর্যবেক্ষক তিনিই। যিনি খুন হয়েছেন, সেই কাশেম কাজি গোষ্ঠী রাজনীতিতে অনুব্রত-বিরোধী শিবিরের নেতা বলেই পরিচিত।
সোমবার বীরভূমের খয়রাশোলে খুন হয়েছিলেন তৃণমূলের অশোক ঘোষ। পুলিশের কাছে অভিযোগে দলের জেলা সভাপতি অনুব্রতর ঘনিষ্ঠ অশোক মুখোপাধ্যায়-সহ একাধিক নেতা-কর্মীর নাম রয়েছে। প্রথমে অনুব্রতরও নাম ছিল। কিন্তু সিউড়ির তৃণমূল বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষের কথায় পরে তা বাদ দেওয়া হয়। শুক্রবার অশোকবাবুর ছেলে বিশ্বজিৎ জানান, পুলিশ যে কাউকে ধরছে না, বাবার শ্রাদ্ধের পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁরা সেই নালিশ জানাবেন। |
এর পরে সপ্তাহও পেরোল না। বর্ধমানে কাশেম কাজি (৪৭) খুনে ফের জড়াল অনুব্রত অনুগামীদেরই নাম। শুক্রবার বিকেলে মোটরবাইকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে মঙ্গলকোটে ফেরার সময়ে ভাতারের নতুনগ্রামে তাঁকে গুলি করে তিন আততায়ী। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়েই কাশেমের ভগ্নিপতি কাজি মানোয়ারুল হক অভিযোগ করেন, “পঞ্চায়েত ভোটে নির্দল প্রার্থী দাঁড় করানোর পর থেকেই অনুব্রত মণ্ডলের লোকেরা ওকে নিশানা করে। ঘরদোর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ওরাই ওকে খুন করেছে।”
অশোকবাবুকে না চেনা অনুব্রতর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এ দিন তিনি বলেন, “এই সব অভিযোগ যে উঠছে, তা আমার দুর্ভাগ্য। লোকটাকে আমি চিনতাম না। আমাদের দল করত কি না, তা-ও জানি না।” রাতে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “দলের কেউ মারতে ওঁকে যাবে কেন? উনি তেমন বড় কোনও নেতা ছিলেন না। অশোক ঘোষ অনেক বড় নেতা ছিলেন।” অথচ এ দিনই তিনি দাবি করেছেন, “অশোক ঘোষ দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন হয়েছেন বলে যে অভিযোগ উঠছে, তা তৃণমূলকে হেয় করার অপচেষ্টা ও অপকৌশল। এর সঙ্গে কয়লা-মাফিয়া বা মাওবাদীরাও যুক্ত থাকতে পারে।” |
এ দিনের খুন প্রসঙ্গে মুকুলবাবু বলেন, “আমার ব্যক্তিগত ধারণা, সিপিএম ওঁকে মেরেছে।” সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদার পাল্টা বলেন, “নিজেদের দ্বন্দ্ব ঢাকতে এত অসত্য বলা ঠিক নয়।” তৃণমূল সূত্রের খবর, কাশেম কাজির সঙ্গে মঙ্গলকোটে দলের আর এক নেতা শেখ বাসেদ আলির গোষ্ঠীর বিবাদ দীর্ঘদিনের। প্রায়ই দুই গোষ্ঠীর বোমা-গুলির লড়াই বাধে। গত ১৫ জুলাই, বর্ধমানে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনেও তাদের সংঘর্ষের সময়ে বোমা ফেটে বাসেদ-অনুগামী এক যুবক মারা যান। ওই যুবকের দাদাও গত বছর বোমায়
খুন হয়েছিলেন। কাশেমের দাপটে তাঁদের এলাকার বেশ কিছু তৃণমূল কর্মী এখনও ঘরছাড়া।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তাঁর অনুগামী এক অগ্নিদগ্ধ মহিলাকে দেখতে গত তিন দিন যাবৎ বর্ধমান মেডিক্যালে যাতায়াত করছিলেন কাশেম। এ দিন ফেরার সময়ে তিনিই বাইক চালাচ্ছিলেন। পিছনে বছর ষাটের খোরাই শেখ। বর্ধমান থেকে বাদশাহি রোড ধরে মঙ্গলকোটের পথে ভাতারের নর্জা মোড়ে একটি বাইকে তিন জন তাঁদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। খানিক বাদেই ফিরে নতুনগ্রামে সেটি কাশেমের বাইকের মুখোমুখি চলে আসে। এক জন নেমে তাঁর বুকে রিভলভার ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে দেয়। পেটেও গুলি করে। |
পুলিশ জানায়, দেহে চারটি গুলি মিলেছে। মোটরবাইক উল্টে পড়ে মাথা ফাটে খোরাই শেখেরও। তাঁর কথায়, “এর পরে ওরা বর্ধমানের দিকে চলে যায়। ফিরে এসে পা দিয়ে কাশেমের দেহ নাড়িয়ে দেখে, মরেছে কি না। তার পরে মঙ্গলকোটের দিকে চলে যায়।” কাশেমের মেজো ছেলে হাসিবুলের সন্দেহ, “বাবা যে পরপর তিন দিন বর্ধমান গিয়েছেন, সেটা নজর করেই অন্য গোষ্ঠীর লোকেরা খুনের ছক কষেছিল।” বাসেদ আলির দাবি, “পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনের ব্যাপারে আমি তো আজ সারা দিনই মঙ্গলকোট ব্লক অফিসে ছিলাম। কোথায় কী হয়েছে, কি না।”
সন্ধ্যায় ভাতার থানায় মৃতদেহের সামনে বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন কাশেম কাজির স্ত্রী হালিমা বিবি। ছেলের দেহ জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে কাশেমের মা গঞ্জিরা বিবি তখন বলে চলেছেন, “পুলিশ সব জানত। তা-ও ওকে রক্ষা করতে পারল না।”
রাতে রায়নার নাড়ুগ্রামে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে আরও এক জনকে গুলি করা হয় বলে অভিযোগ। তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
|