ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের মহারানি এবং রাজকুমারী দুজনেরই জন্ম গোপীচন্দের অ্যাকাডেমিতে। সাইনা নেহওয়াল এবং পি ভি সিন্ধু।
গাচ্চিবোলির এই অ্যাকাডেমির জন্য এখন গোটা দুনিয়া মেনে নিচ্ছে, ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের রাজধানী হায়দরাবাদ। আর সেই হায়দরাবাদের নিজামের নাম পুল্লেলা গোপীচন্দ। মাত্র ন’বছরে যাঁর সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়েছে নয় নয় করে ন’জন বিশ্বের শীর্ষমানের ব্যাডমিন্টন তারকা। সাইনা নেহওয়াল থেকে সিন্ধু। পারুপল্লি কাশ্যপ থেকে সাই প্রণীত। জ্বালা গাট্টা থেকে কিদম্বি শ্রীকান্ত। এইচ এস প্রণয়। গুরুসাই দত্ত...। যাঁরা সব মিলিয়ে দু’ডজনের বেশি আন্তর্জাতিক পদক এনেছেন গোপীচন্দ অ্যাকাডেমির ট্রফি-রুমে। কখনও অলিম্পিক থেকে। কখনও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে। কখনও জুনিয়র বিশ্ব মিট, সুপার সিরিজ, গ্রাঁ প্রি, এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপ, ইন্ডিয়ান ওপেন থেকে। এত সফল খেলোয়াড় তৈরির কারখানা ভারতবর্ষে বোধহয় আর কোনও ইভেন্টে নেই।
কেন? কী ভাবে? |
কোথায় গোপীর অ্যাকাডেমি দেশের বাদবাকি ব্যাডমিন্টন অ্যাকাডেমিগুলোর থেকে বহু মাইল এগিয়ে?
প্রকাশ পাড়ুকোন মোবাইলে সটান স্বীকার করলেন, “কোনও কাজের পিছনে গোপীর চূড়ান্ত লেগে থাকার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। ওর অ্যাকাডেমির অত্যাধুনিক পরিকাঠামো আর ওর সাপোর্ট স্টাফের একশো দশ ভাগ দায়বদ্ধতাএই তিনে মিলে গাচ্চিবোলির অ্যাকাডেমিকে সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায় তুলে দিয়েছে।” পাড়ুকোন হিসেব দিলেন, এখনও অশ্বিনী পোনাপ্পা কিংবা অজয় জয়রামের মতো আন্তর্জাতিক মানের ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার বেঙ্গালুরুতে তাঁর নিজের অ্যাকাডেমি থেকে বেরিয়েছে। “কিন্তু গোপীর বিশেষত্ব হল, বছরে প্রতি দিন ভোর থেকে রাত ও অ্যাকাডেমি নিয়েই পড়ে থাকে। যেটা আমরা হয়তো কেউ পারি না। গোপী নিজেও পাঁচ-ছ’বছর আমার অ্যাকাডেমিতে ট্রেনিং করেছে। তখনই দেখতাম, কোন ট্রেনিংটা ও কেন করছে? তাতে কী লাভ? প্লেয়ার হিসেবেও এ সব জানার প্রচণ্ড ইচ্ছে ওর। কোচিংটা বোধহয় গোপীর ভেতর একটা জন্মগত ক্ষমতা।”
তিনটে বহুচর্চিত ‘ডি’ (ডেডিকেশন-ডিটারমিনেশন-ডিসিপ্লিন) গোপীর অ্যাকাডেমিতে তো আছেই। তার চেয়েও বোধহয় গুরুত্বপূর্ণ চিফ কোচ গোপীচন্দের নিজস্ব ‘ডি’ ডায়নামিজম। গোপী বরাবর ব্যাডমিন্টনে চিনা মডেলের ভক্ত। যে মডেল প্রথম দেখিয়েছিল, স্কিলের সমানই (যদি বা না বেশি) দরকার ফিটনেস। তার পাশাপাশি দরকার নিখুঁত ডায়েট, এনডিওরেন্স, বডি মেকানিজম-ও। আর সেগুলো ঠিকঠাক অর্জনের রাস্তা একটাইপ্র্যাক্টিস, আরও প্র্যাক্টিস। নিজেকে উদাহরণ হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে পেশ করার জন্য গোপীস্যার অ্যাকাডেমিতে সবার আগে ঢোকেন। বেরোন সবার পরে। গুরুই যদি রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে দৈনিক পনেরো-ষোলো ঘণ্টা অ্যাকাডেমিতে পড়ে থাকেন, তা হলে শিষ্যরা সকাল-দুপুর-সন্ধে তিন খেপে রোজ বারো-চোদ্দো ঘণ্টা প্র্যাক্টিস করবে না কেন? চিনে ‘বিপ্লব’ ঘটিয়ে ফেরার পর গোপীচন্দ ফোনে বলছিলেন, “আমার অ্যাকাডেমির চার কিলোমিটারের ভেতর একটা ভাড়াবাড়িতে আমি থাকি শুধু যাতে অন্তত লাঞ্চটা সারতে বাড়ি ফেরা যায়! নইলে শুধু খাওয়ার জন্য ষাট কিলোমিটার জার্নি!”
গোপী স্যারের কোচিং-দর্শন খুব সহজ। “নিজের খেলোয়াড়জীবনে ভাল ট্রেনিংয়ের জন্য দরজায়-দরজায় ঘুরেছি। দেখেছি সবটাই পরীক্ষানিরীক্ষা মূলক কোচিং সিস্টেম। গ্যারান্টেড সাকসেস ফর্মুলা বলে কিছু নেই এ দেশের ব্যাডমিন্টন কোচিংয়ে। বুঝেছি, এই খেলাটায় বিশ্বমানে পৌঁছতে হলে ছোটবেলা থেকেই শুরু করতে হবে। কিন্তু কোনও সমস্যা নিয়ে অন্যকে দোষারোপ করে লাভ নেই। তোমাকে নিজেকেই সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। যদি মনে করো যে, পরের প্রজন্ম তোমার অবস্থায় না পড়ুক। আমি সেটা খেলতে খেলতেই মনে করেছি বলে আজ এই অ্যাকাডেমি।” আম্তরিক ভাবে স্বীকার করলেন প্রাক্তন অন্ধ্রপ্রদেশ মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু আর দক্ষিণের বিখ্যাত শিল্পপতি ‘ম্যাট্রিক্স’ প্রসাদের ‘চিরঋণ’। “চন্দ্রবাবু নাইডু সরকার আমাকে পাঁচ একর জমি দিয়েছিল। আর নিমাগাড্ডা প্রসাদ এক দিন আমার সঙ্গে কফি খেতে খেতে পাঁচ কোটি টাকার চেক লিখে দিয়েছিলেন। নইলে আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত।”
গোপী ট্রেনিংয়ে চিনা মডেলের ভক্ত হলেও তাঁর অ্যাকাডেমিতে কোচিং স্টাফের চার জন ইন্দোনেশিয়ান। একজন ড্যানিশ। কেন? অ্যাকাডেমি প্রধানের ব্যাখ্যা, “খোদ চিনেও অনেক অ্যাকাডেমিতে দেখেছি ইউরোপিয়ান ট্রেনার। ইন্দেনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মতো অন্য এশীয় দেশের কোচ। আসলে কোচিং মডেলটাই আসল। সেটা কে প্রয়োগ করছে সেটা নয়।” তাবড় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সাইনা-সিন্ধু-কাশ্যপদের ম্যাচ চলাকালীন কোর্টের ধারে তাঁর টিপসের কী বিশেষত্ব? যার জোরে সাইনা-সিন্ধুদের এত সাফল্য? জানতে চাইলে সাইনাদের গোপীস্যার সলজ্জ গলায় বললেন, “ওটা কিন্তু কোনও চিনা মডেল-টডেল নয়। ওটা আমার গেমপ্ল্যান। পুরোদস্তুর ভারতীয়।”
|
গোপী স্যারের ক্লাস-রুম |
• আন্তর্জাতিক মানের কোর্ট ৮
• অত্যাধুনিক হেল্থ ক্লাব ২
• রানিং ট্র্যাক ১টা বড়, ১টা ছোট
• সুইমিং পুল
• রিহ্যাব আর ওয়েলনেস সেন্টার
• ঘুমনোর ঘর ৪টে
• অফিস রুম
• ইন্টারনেট রুম
• গোটা অ্যাকাডেমিটা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত
• মোট জায়গা ৫ একর
• অ্যাকাডেমির সম্পদ প্রায় ৫০ কোটি টাকার
• ‘স্যারের’ দৈনিক প্রবেশ ভোর ৪টে বেজে ১৫ মিনিটে
• প্রস্থান সন্ধে ৭টার পর |
|