|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
রাষ্ট্র স্বাধীনতা পেয়েছে, স্বাধীনতা দিতে পারেনি
স্বাতী ভট্টাচার্য |
রাষ্ট্রকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিতে যাঁরা লড়াই করেছিলেন, তাঁদের উত্তরপুরুষ আজ রাষ্ট্রের অন্নদাস। অন্নদাস নয়তো কী? তাকিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয়, দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ প্রতিদিনের উদরপূর্তির জন্য হয় পাত পাতে, নইলে হাত পাতে সরকারের কাছে। কখনও তা অঙ্গনওয়াড়ির ঘর কিংবা গাছতলায়, কখনও স্কুলের মিড ডে মিলের বারান্দায়, কখনও থলে-হাতে রেশন দোকানের লাইনে, কখনও বা বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনও চিলতে জমিতে, ‘সহায়’ প্রকল্পের থালা পেতে। রাষ্ট্র মাথাপিছু খাবারের পরিমাণ যেমন বাড়াচ্ছে, তেমনই বাড়াচ্ছে খাবার বিতরণের প্রকল্পের সংখ্যা। সে দিন কাগজে পড়া গেল, অন্ধ্রপ্রদেশে ‘আজীবিকা’ নামে এক প্রকল্প খুব জনপ্রিয় হয়েছে। কী সেই প্রকল্প? গরিব মেয়েরা গর্ভবতী হলে দু’বেলা খেতে তো পাবেনই, সকালের জলখাবারও পাবেন। যত দিন শিশুকে স্তন্যপান করাবেন, তত দিন তাঁদের এই খাওয়া চলবে। শিশুরা তিন বেলার খাবার পাবে দু’বছর পর্যন্ত। সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, চলতি প্রকল্পগুলোর সঙ্গে এটাও যোগ হবে।
তার মানে কী দাঁড়াল? একটি শিশু গর্ভে থাকতে থাকতেই সরকারি অন্নে তার প্রতিপালনের শুরু। দু’বছর পর্যন্ত সে খাবে ‘আজীবিকা’ প্রকল্পের অধীনে, তার পর ছয় বছর পর্যন্ত অঙ্গনওয়াড়িতে, ৬-১৪ বছর সর্বশিক্ষা মিশনের টাকায় মিড ডে মিল প্রকল্পে, ১৫-১৮ বছর মাধ্যমিক শিক্ষা মিশনের টাকায় মিড ডে মিল প্রকল্পে। যদি সে কন্যা হয়, তবে ১৮ পূরণের পরে পরেই তার বিয়ে এবং গর্ভবতী হওয়ার পালা, তখন আবার সেই চক্রের শুরু তার জীবনে। পুরুষ হলে ১৮ বছরের পর প্রাপ্য রেশনে ভর্তুকির চাল-গম, খাদ্য নিরাপত্তা বিল গ্রামের মানুষের তিনজনের দু’জনকেই তিন টাকা কিলো চাল, দু’টাকা কিলো গম দেবে। রয়েছে জয়ললিতার এক টাকার ইডলি কিংবা মমতার রেলযাত্রীদের জন্য ‘জনতা আহার’-এর মতো ব্যবস্থা, জনসমর্থনের তাগিদে নেতারা যার দরজা খুলে রেখেছেন সবার জন্য। বার্ধক্যে ‘সহায়’ প্রকল্পের টাকায় এক বেলা রান্না-করা খাবার, এক বেলা চিঁড়ে গুড়ের মতো শুকনো খাবার বরাদ্দ। মানে, স্বাধীনতার ৬৭তম বছরে জন্মাচ্ছে যে শিশু, রাষ্ট্র তাকে ‘গরিব’ তকমা দিলে প্রায় গোটা জীবনচক্র জুড়ে পাবে রাষ্ট্রের দেওয়া ভর্তুকির খাবার, নইলে বিনিপয়সার খাবার। |
|
অনেকে বলবেন, এ তো ভালই। খিদে থেকে স্বাধীনতা, দারিদ্র থেকে স্বাধীনতা, এমনই তো আমরা চেয়েছিলাম। প্রতিটা মানুষের যে পুষ্ট, নীরোগ জীবন বাঁচার অধিকার রয়েছে, সে কথা রাষ্ট্র স্বীকার করেছে, এটাই কি গণতন্ত্রের জয় নয়? গরিবের ইচ্ছারই কি প্রতিফলন হয়নি খাদ্য নিরাপত্তার এই বিপুল ব্যবস্থায়? উত্তর, অবশ্যই, হ্যাঁ। পেট পুরে খেতে পাওয়া মানুষমাত্রেরই ইচ্ছা। কিন্তু স্বাধীনতার ইচ্ছা? নিজের প্রয়োজন নিজে মেটাতে পারার তৃপ্তি? সেটাও কি ততটাই মৌলিক, ততটাই নিবিড় কোনও তাগিদ নয়? বি ডি ও-পঞ্চায়েত প্রধান-রেশন ডিলার-মুখী জীবন থেকে মুক্তি, ‘কাল-পরশু আসবেন’ ‘বাইরে বসুন’ ‘এখানে কী জন্য?’ গোছের তাচ্ছিল্য-বাক্য থেকে মুক্তির স্বপ্ন গরিব কি দেখে না? কোনও মতে বেঁচে থাকাই যদি গরিব মানুষের একমাত্র তাগিদ হত, দুনিয়া অনেক সহজ জায়গা হত তা হলে। প্রাণ বিপন্ন করে যত আন্দোলন, সেই চিপকো থেকে সর্দার সরোবর, তেভাগা থেকে নন্দীগ্রাম, মার খেয়েছে, মারা গিয়েছে কারা? অমর্ত্য সেন লিখছেন, অন্যের জন্য কিছু করার মাধ্যমে নিজের মর্যাদার অনুভব, অতি-গরিবের মধ্যেও যে সেই ইচ্ছে থাকে, তা ভারতে নানা আন্দোলনে বার বার বোঝা গিয়েছে। কে জানে, ইচ্ছে মতো পাওয়ার স্বাধীনতা কম বলেই হয়তো ইচ্ছে মতো ত্যাগ করার স্বাধীনতা গরিবের কাছে এত মূল্যবান।
কিন্তু অন্যের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকে বহু মানুষ বহু অসম্ভব কাজ করলেও, শেষ বিচারে মানুষের ক্ষমতার পরিচয় নিজের জন্য সে কী করতে পারে। নিজের জীবনকে যতটা অর্থবহ, সুন্দর, সফল করে তুলতে পারি, আমরা ততটাই স্বাধীন। ধনীর ঘরের মেয়েও নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে না পারলে সারা জীবন নিজেকে অকিঞ্চন মনে করে। উকিলের ছেলেকে অনিচ্ছায় উকিল হতে হলে প্রচুর পসার জমিয়েও তার অতৃপ্তি, আত্মগ্লানি দূর হয় না। যার ইচ্ছার মূল্য অন্যের কাছে নেই, তার ‘স্বাধীনতা’ও মূল্যহীন। দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী তাই স্বাধীনতার অর্থ করেছেন, ‘পরস্পর অধীনতা।’ তুমি আমার ইচ্ছার অধীন, আমিও তোমার ইচ্ছার অধীন। তুমি নিজের ইচ্ছা মতো কাজ করতে পারো ততক্ষণই, যতক্ষণ তা আমার ইচ্ছাকে আঘাত না করে।
গরিবকে ‘নিরাপত্তা’ দিতে গিয়ে তার খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, মজুরি, বিমা-পেনশন সবই রাষ্ট্রনির্ভর করার সমস্যা এখানেই যে, এর কোনওটির বিষয়েই গরিবের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা করে না রাষ্ট্র। ‘ভিক্ষের চাল আবার কাঁড়াআকাঁড়া’, এই হল সরকারের মনোভাব। গরিব মানুষ কেমন খাবার খেতে পছন্দ করছে, কী শিক্ষা সে দিতে চাইছে ছেলেমেয়েকে, কেমন চিকিৎসা তার প্রয়োজন, তার তোয়াক্কা না করেই ঢালাও ব্যবস্থা চলছে। ফলে গরিবও রেশনের দু’টাকার চাল বাজারে বেচে কিনছে তেল-চিনি, অঙ্গনওয়াড়িতে সন্তানের নাম লিখিয়ে পড়াতে পাঠাচ্ছে নার্সারি স্কুলে। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের চাহিদাও কমছে গোটা দেশে। মজুরি পেলেই লোক খুশি, এমন সরকারি চিন্তার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে, অর্থহীন, অকারণ পরিশ্রমে বিরক্ত মজুররাই। তাঁরা বরং প্রস্তাব দিচ্ছেন, মেশিন চালিয়ে ড্রেজিং করা হোক পুকুর, মাটির ফেলার কাজের জন্য যেটুকু মজুরি হয়, তা-ই পাক মজুররা। হাতে কাটলে পুকুরে কোনও দিন জল উঠবে না। এ সব দেখেশুনে এক দিকে দুঃখ হয়, বিপুল সরকারি বরাদ্দ নষ্ট হচ্ছে বলে। অন্য দিকে একটু আশ্বস্ত হওয়া যায়। সরকার যা-ই ভাবুক, গরিব নিজেকে কেবল রাষ্ট্রের কাছে হাত-পাতা ‘বেনিফিশিয়ারি’ ভাবতে রাজি নয়।
অথচ রাষ্ট্রের সঙ্গে মোকাবিলায় যখন তাকে যেতে হয়, তখন সেই জুতোতেই পা গলাতে হয় গরিব মানুষকে। বীরভূমে বছর দশেকের অন্তরে বেশ কিছু গ্রাম সভায় গিয়ে দেখা গেল, নিজেদের বিপন্নতা-অসহায়তা প্রমাণ করার একটা প্রতিযোগিতা চলে তৃণমূলের স্তরে গণতন্ত্রের এই মঞ্চে। ‘ওর টিনের চালে ফুটো বলে ইন্দিরা আবাসের ঘর দিলে, এ দিকে আমি থাকি রাস্তায়, আমার কী হবে?’ ‘ওর বর মারা গিয়েছে বলে বিধবা ভাতা দিলে, আমার বরও নেই দুটো ছেলেও পঙ্গু তবু কিছু পাই না।’ এক মহিলাকে সবাই ধরে-টরে দাঁড় করিয়ে দিলে তিনি কাতর স্বরে বললেন, ‘কী বলব? আমি কিছু বলতে পারব না,’ তখন পাশ থেকে এক জন বলে দিচ্ছেন, ‘বলো আমি বিধবা, আমার কেউ নেই, আমার জন্য কিছু করুন।’ কখনও দক্ষিণ ভারতে, কখনও পশ্চিমবঙ্গে, গবেষকদের নিরীক্ষায় ধরা পড়ছে যে, বিশেষত নিম্নবর্ণ এবং মহিলাদের কাছে এই কাতর আবেদন-নিবেদনের ভাষাই নাগরিকের দাবি-আদায়ের ভাষা। তার কারণ এই নয় যে আর কোনও উপায় তাঁর সামনে নেই বহু গ্রামে সম্পূর্ণ নৈঃশব্দ্য, বা মারমুখী হট্টগোল দিয়ে সভার মানুষ চাপ তৈরি করেন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের উপর। কিন্তু অতি-দরিদ্র, মহিলা ও বৃদ্ধরা রাষ্ট্রের সঙ্গে মোকাবিলার এই উপায়টি যেন সবচেয়ে কার্যকর মনে করছেন। তাঁদের কাছে নাগরিকের ‘স্বাধীনতা’ এই দাবি জানানোর স্বাধীনতা, ‘সক্ষমতা’ মানে ইন্দিরা আবাস কিংবা বিধবা ভাতা পাওয়ার ক্ষমতা। গভীরতর গণতন্ত্র, ব্যাপকতর ক্ষমতায়ন তাঁকে এই ভিক্ষুকের ভূমিকা থেকে বেরোতে দেয় না, বরং সেই নকশাকে আবারও খোদাই করে।
রাষ্ট্র সেই নকশাকে আরও গভীর করছে রিলিফ-প্রত্যাশীদের টুকরো টুকরো ভাগ করে। সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, প্রথাগত কৃষি আন্দোলনে গ্রামবাসী-কৃষক রাষ্ট্রকে দায়ী করত শোষণ-উৎপীড়নের জন্য। তখন রাষ্ট্র ছিল গ্রামসমাজের বাইরে, প্রতিকূল এক শক্তি। এখন সরকারি প্রশাসন প্রবেশ করেছে গ্রামসমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, রাষ্ট্রের সঙ্গে গ্রামবাসীর নিত্য-সাক্ষাৎ, তাকে প্রভাবিত করা, নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলও আর অজানা-অধরা নয়। আজ কৃষকসমাজ তথা গ্রামসমাজের প্রতিপক্ষ জমিদার বা ব্যবসাদার নয়, অভিযোগও শোষণের নয়। তাদের আন্দোলন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, আর অভিযোগ বৈষম্যের। ওদের দিলে, আমাদের দিলে না, ওরা পেল, আমরা পেলাম না যে কোনও কৃষক আন্দোলনের নৈতিকতা এখন এই নালিশ থেকে উৎসারিত হচ্ছে। ফলে গণ-আন্দোলনের চরিত্রটাই একেবারে বদলে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বা ওড়িশায় তাই গত দু’দশকে দেখা যাচ্ছে, কৃষিজমি অধিগ্রহণ-বিরোধী আন্দোলনে গ্রামের কিছু অংশের মানুষ যোগ দিচ্ছেন না। কারণ তাঁরা মনে করেন, রাষ্ট্রের থেকে তাঁরা যা পাচ্ছেন, পেতে পারেন, তার মূল্য আন্দোলনের মাধ্যমে সম্ভাব্য লাভের চেয়ে বেশি।
গরিবে-গরিবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার টানাপড়েনে রাজনীতির নকশা নির্মাণ হচ্ছে। রাষ্ট্র কিন্তু তার নিজের তাগিদেই আরও ‘ইনক্লুসিভ’ হচ্ছে প্রাপ্যের পরিমাণ আর প্রাপকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়িয়ে চলেছে। রাষ্ট্রকে তার নৈতিক শক্তি বজায় রাখতে হবে। বিপুল সংখ্যার মানুষ, যাঁরা বাজারের উপর নির্ভর করে কখনওই বেঁচেবর্তে থাকার মতো রোজগার করতে পারবেন না, তাঁদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। সেটা ভিতরের তাগিদ। বাইরেরও তাগিদ আছে। জনসংখ্যার অর্ধেক অপুষ্ট, অশিক্ষিত, রুগ্ণ রেখে ভারত কোনও দিন বিশ্বে ‘উন্নত দেশ’ হয়ে উঠতে পারবে না। বৃদ্ধির সূচকের সঙ্গে মানব উন্নয়নের সূচকের একটা সামঞ্জস্য রাখতেই হবে। তাই সরকারি খরচে দেশ জুড়ে ‘কমিউনিটি কিচেন’ তৈরি হয়েই চলেছে। রাষ্ট্র স্বাধীনতা পেয়েছে, রাষ্ট্র স্বাধীনতা দিতে পারেনি। পেটচুক্তির ভোটচুক্তি, এই হল নাগরিক আর রাষ্ট্রের সম্পর্ক। |
|
|
|
|
|