হাল্কা হওয়ার মন্তর
কাগজ-পেনসিলে হিজিবিজি, চাপ কাটাতে দিদির দাওয়াই
হাতের কাছে একটা পেনসিল আর এক টুকরো সাদা কাগজ রাখো। আর যা ইচ্ছে হিজিবিজি আঁকো।
কাজের জায়গায় মানসিক চাপ কমাতে নতুন বিডিওদের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দাওয়াই।
২০১০ সালে ডব্লিউবিসিএস পাশ করেছেন ওঁরা। সকলেরই গড় বয়স তিরিশের মধ্যে। মঙ্গলবার মহাকরণের রোটান্ডায় ৭৪ জন নতুন বিডিও-র মুখোমুখি হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম প্রতিক্রিয়া, “ও বাবা! এ তো দেখছি সকলেই অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে! মানিয়ে নিয়ে চলতে পারবে তো?” সকলেই ঘাড় নেড়ে মুখ্যমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন, “পারব ম্যাডাম, ঠিক পারব।” তার পরেই ওঠে কাজের চাপের প্রসঙ্গ। মমতা বলেন, “তোমরা দেখবে যাতে কাজ করতে গিয়ে অযথা চাপের মধ্যে পড়তে না হয়। অফিসের কাজ অফিসেই শেষ করে বাড়িতে যাবে। যাতে বাড়িতে গিয়েও অফিসের কথা না মনে হয়।” এর পরেই স্বভাবসিদ্ধ ভাবে চাপ কমানোর উপায় বাতলিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানান, কাগজে হিজিবিজি কাটা তাঁর নিজেরও অভ্যাস।
দৃশ্যটা অবশ্য মহাকরণের অনেকেরই চেনা। মুখ্যমন্ত্রীর অফিসেই তৈরি হয়েছে স্টুডিও। কাজের ফাঁকে সেখানে নিয়মিত ছবি আঁকেন তিনি। ছবি আঁকতে আঁকতেই রাজ্যপাট পরিচালনার বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করেন। অফিসাররা অনেকেই বলেন, ছবি আঁকার সময় মুখ্যমন্ত্রীর মেজাজ থাকে তোফা। বিধানসভায় অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশের সময়ও মমতাকে আপন মনে ছবি আঁকতে দেখা গিয়েছে। এ ছাড়াও চাপ কমাতে ময়দানের এক পার্কে রোজ সন্ধ্যায় ৪৫ মিনিট হাঁটেন তিনি।
মাথায় চিন্তা বেহাল কোষাগার। বাজেট বক্তৃতার ফাঁকে
আঁকিবুকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। —ফাইল চিত্র
চাপের মুখে নিজেকে শান্ত রাখতে রাজনীতিকদের অনেকেই এমন নানা পথে হাঁটেন। আঁকিবুকি কাটার অভ্যাসও মমতার একার নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত মনোবিদ সুদীপ বসু বলেন, “ইন্দিরা গাঁধীও এমন হিজিবিজি কাটতেন বলে শুনেছি। কোনও বিষয় নিয়ে থেকে মনটাকে সরাতে কাগজে হিজিবিজি কাটা যেতেই পারে।” প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সংসদে দেখা যেত, চাপের মুখে দু’হাতে নিজের চিবুক ও গাল খামচে ধরতে। লালকৃষ্ণ আডবাণীর আবার পা নাচানো বেড়ে যায়। ঘন ঘন কেশবিহীন মাথায় আঙুল বোলান, হাত কচলান বিজেপি-র লৌহপুরুষ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর আবার পরিচিত ভঙ্গি ছিল, বারবার চশমা ঠিক করা। সঙ্গে মুহূর্মুহূ সিগারেট। মহাকরণে তাঁর সঙ্গে কাজ করা আধিকারিকরা বলেন, চাপের সময় নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেও মনটা ঘোরানোর চেষ্টা করতেন বুদ্ধবাবু। আর তাঁর পূর্বসূরি জ্যোতি বসুর আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল নিজেকে নির্লিপ্ত রাখার। চন্দন বসু বলছিলেন, “বাবা (জ্যোতিবাবু) নিজেই বলতেন, যখনই চাপে থাকি, বিষয়টা থেকে নিজেকে সুইচ অফ করে নিই।”
রাজনীতিকদেরই শুধু নয়, প্রবল চাপ নিতে হয় নামী খেলোয়াড় বা সিনেমা-তারকাদেরও। তাঁদেরও এক-এক জনের এক-এক রকম মুদ্রাদোষ আছে, আছে চাপ কাটানোর নিজস্ব পদ্ধতি। কাছ থেকে দেখেছেন যাঁরা, তাঁরা বলেন, মাঝারি গোছের চাপের মধ্যে মোটামুটি স্বাভাবিকই থাকতেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। চাপ বেশি বাড়লে চুপ করে যেতেন। রাহুল দ্রাবিড়ের অভ্যাস ছিল জ্যোতিবাবুর মতো ‘সুইচ অফ’ করে নেওয়ার। সুনীল গাওস্কর বা সচিন তেন্ডুলকর কিন্তু অনেক বেশি টেনশন-প্রবণ। গাওস্কর স্বীকার করেন, তিন-তিনটে ডবল সেঞ্চুরির আগের রাতে ঘুমোতে পারেননি। ঘুম উড়ে যায় সচিনেরও। ক্রিকেট-দর্শক মাত্রেই খেয়াল করেছেন তাঁর নখ খাওয়ার অভ্যাসটিও।
সত্যজিত রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে দেখা গিয়েছিল, উত্তমকুমার চাপ কমাতে ঘুমের ওষুধের আশ্রয় নিচ্ছেন। বেড়ে যাচ্ছে সিগারেটের রিং ছাড়া। পরে এই দ্বিতীয় অভ্যাসটা ফেলুদার মধ্যেও বর্তেছিল। আর শর্মিলা ঠাকুর লিখেছেন, সেট-এ দীর্ঘদেহী পরিচালকের নিজের বাতিক ছিল রুমাল চিবোনো। প্রতিদিন একটা করে রুমাল লাগত।
তবে মমতা হিজিবিজির যা দাওয়াই দিয়েছেন, সেটা চাপ কাটানোর একটা ভাল পন্থা বলে মানছেন মনোবিদরা। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মনোবিদ প্রথমা গুহর মতে, “মানসিক চাপের সময় যে অনিয়ন্ত্রিত আবেগ তৈরি হয়, তা নিরাপদ উপায়ে বের করে দিলেই চাপমুক্তি হয়। হিজিবিজি কাটা তেমন একটা উপায় হতেই পারে।”

দু’হাতে চেপে ধরেন
নিজের চিবুক

মাথায় হাত বোলান,
পা-ও নাচান ঘনঘন

সমস্যা থেকে মনটাই
সরিয়ে নিতেন

বারবার চশমা ঠিক করেন। আগে
বেড়ে যেত সিগারেট খাওয়াও
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের নীলাঞ্জনা স্যানালের কথায়, “ছোট বাচ্চারা জ্বালাতন করলে অনেক সময় আমরা কাগজ-পেনসিল দিয়ে বসিয়ে দিই। দুষ্টুমি থেকে মন সরাতে তাদের হিজিবিজি কাটতেই বলা হয়।” তবে সকলের জন্যই যে হিজিবিজির টোটকা কাজ করবে, তা নাও হতে পারে। সুদীপবাবুর মতে, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন বলে সবাইকে হিজিবিজি কেটেই চাপ কমাতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। যার যা করলে মন শান্ত হয়, সেটাই করা ভাল।” সেটা কেউ পা নাচিয়ে, কেউ গান শুনে বা গান গেয়ে চাপ কমাতে পারেন। কেউ হয়তো পায়চারি করেন।
চিকিৎসক সত্যজিৎ বসু নিজে একটি হাসপাতালের দায়িত্ব সামলান, পাশাপাশি হৃদযন্ত্রে জটিল সব অস্ত্রোপচার চলে নিত্যদিন। মঙ্গলবার তেমনই একটি টানা আট ঘণ্টার অস্ত্রোপচার শেষে বললেন, “কাজ করতে গেলে চাপ থাকবেই। চাপ কাটানোটাই আসল।” তার জন্য কাজের পরিকল্পনা আর হাতেকলমে সেটা করার প্রক্রিয়াটাকে আলাদা রাখতে হবে। সময় ‘ম্যানেজ’ করতে শিখতে হবে। কাজকে উপভোগ করতে হবে। এ দিন অস্ত্রোপচারের মধ্যে নিজে বেশ কয়েক বার বড় করে শ্বাস নিয়ে, মাঝে মাঝে মন অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিজেকে শান্ত রেখেছেন তিনি।
চাপ কমাতে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনের কর্তারাও যে যাঁর মতো করেই নানা রাস্তার সুলুকসন্ধান করে নেন। মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র রোজ সকালে জিম-এ যান, যোগ ব্যায়াম করেন। এ দিনের বৈঠকে উপস্থিত রাজ্যের স্বরাষ্ট্র কর্মিবর্গ দফতরের সচিব অজিতরঞ্জন বর্ধন গল্ফ খেলে, গান শুনে চাপ কাটান। স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিশেষ ভক্ত। মহাকরণে তাঁর ডেক্সটপে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ১৬০০ ঘণ্টার ভাণ্ডার রয়েছে।
গান শোনাটা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীরও চাপ কাটানোর আর একটা উপায়। তাঁর আইপ্যাডে অনেক গানের সম্ভার। সময় পেলেই শোনেন। গত বছর নতুন বিডিওদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় গান শুনতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সে বার বিডিও পুষ্পেন চট্টোপাধ্যায় তাঁকে শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান। এ দিনও বিডিও-দের কাছ থেকে গান শোনার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সময়াভাবে তা আর হয়নি।
চাপ কমানোর প্রেসক্রিপশনটা কেমন লাগল? কল্যাণীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ফেরার পথে এক নবীন বিডিও-র মন্তব্য, “বেশ ইন্টারেস্টিং, ওই হিজিবিজিটা!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.