রেকর্ড এক্সপ্রেস।
শাহরুখ খানের নতুন ছবিকে এখন এই নামেই ডাকছে বলিউড। প্রথম সপ্তাহান্তের মধ্যেই ‘চেন্নাই এক্সপ্রেসে’র ব্যবসা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। এর আগে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডটা ছিল সলমন খানের কব্জায়। গত বছর ‘এক থা টাইগার’ ছ’দিনে ১০০ কোটি তুলেছিল। আর প্রথম সপ্তাহান্তে সবচেয়ে বেশি টিকিট বিক্রির রেকর্ডটা করেছিলেন রণবীর কপূর। এই ক’দিন আগেই রণবীর-দীপিকার ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’ ৬২ কোটি টাকার ব্যবসা দিয়েছিল প্রথম সপ্তাহান্ত পার করেই। দীপিকাকে সঙ্গে নিয়েই সেই রেকর্ডটাও ভেঙে দিলেন শাহরুখ।
আরও আছে। ‘চেন্নাই’-এর রেকর্ড এতেই ফুরোয়নি। আলাদা আলাদা ভাবে প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় দিনের সবচেয়ে বেশি ব্যবসার রেকর্ডও এখন ‘চেন্নাই’-এর। এর আগে প্রথম দিনে ৩১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা আয়ের রেকর্ড ছিল ‘এক থা টাইগার’-এর। ‘চেন্নাই’ সেই অঙ্কটা নিয়ে গিয়েছে ৩৩ কোটি ১২ লক্ষে। দ্বিতীয় দিন ২৯ কোটি ৫ লক্ষ এবং তৃতীয় দিন ৩২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার ব্যবসা করেছে চেন্নাই। সেগুলোও রেকর্ড, বলাই বাহুল্য।
কথায় বলে, সকালটা দেখলেই বোঝা যায় দিন কেমন যাবে। চেন্নাই এক্সপ্রেস যে সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়তে চলেছে, সেটা বোঝা গিয়েছিল বৃহস্পতিবারের পেড প্রিভিউ থেকেই। রেকর্ডের শুরু তখনই। সবচেয়ে বেশি টাকার পেড প্রিভিউ এর আগে পেয়েছিল আমির খানের ‘থ্রি ইডিয়টস’ (২০০৯)। ২ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ সেখানে পেড প্রিভিউ-এর শো থেকে ৬ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা তুলে ফেলে। আর ঠিক তখন থেকেই বক্স অফিস বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করেন, সব ঠিকঠাক চললে সামনের তিন দিনে ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবেন শাহরুখ। সে দিক থেকে দেখতে গেলে, ‘চেন্নাই’য়ের সাফল্য অপ্রত্যাশিত কোনও চমক নয়। এটাই ঘটার ছিল, এবং ঘটল।
একটি সফল দাক্ষিণাত্য অভিযান শাহরুখকে বাদশাহ-র মুকুট ফিরিয়ে দিল। |
এত দিন শাহরুখ ‘দীপাবলির রাজা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শাহরুখের একাধিক বড় রিলিজ ছিল দেওয়ালির সময়তেই। বিশেষত গত কয়েক বছরে ‘মাই নেম ইজ খান’ বাদে শাহরুখের বড় ছবিগুলো প্রায় সব ক’টাই দীপাবলিতে মুক্তি পেয়েছিল। ঈদের ছুটিটা ছিল সলমন-ভক্তদের জন্য। ওয়ান্টেড, দাবাং, বডিগার্ড বা এক থা টাইগার সব ক’টাই ঈদ রিলিজ। চেন্নাই এক্সপ্রেসের পর কিন্তু শাহরুখকে এখন ‘ঈদের রাজা’ও বলা শুরু হয়ে গিয়েছে।
ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই বলছেন, এটাই হচ্ছে কৌশল। খুব ভেবেচিন্তে অঙ্ক কষেই শাহরুখ এ বার দু’টো কাজ করেছিলেন। এক, রোহিত শেট্টির মতো হিট-মেশিনের সঙ্গে জুটি বাঁধা। দুই, ঈদের ছুটিটা কাজে লাগানো। গত কয়েক বছরে ব্যবসার অঙ্কে শাহরুখকে অনেকটাই পিছনে ফেলেছিলেন সলমন। এই মুহূর্তে সলমনই বলিউডের একমাত্র অভিনেতা, যাঁর ঝুলিতে পাঁচ-পাঁচটা ১০০ কোটি কামানো ছবি। তার পরেই অজয় দেবগণ, চারটি। শাহরুখ ছিলেন তিন নম্বরে। তাঁর ডন টু, রা ওয়ান বা জব তক... অঙ্কের হিসেবে একশো কোটির ক্লাবে ঢুকেছিল বটে। কিন্তু ব্লকবাস্টার-সুলভ উন্মাদনা বা হইচই তৈরি করতে পারেনি। একটা হিটের জন্য শাহরুখ তাই মরিয়া ছিলেন। সলমনের মাঠেই সলমনকে হারানোর তাগিদও কাজ করছিল। ইন্ডাস্ট্রি বলছে, তাই ঈদকে বেছেছিলেন শাহরুখ! সেই কারণেই গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন রোহিতের সঙ্গে।
রোহিত শেট্টি মানে কী? অ্যাকশন আর কমেডির চড়া মশলাদার ককটেল। সমালোচকদের মন কাড়তে না পারে, কিন্তু বক্স অফিসে অনিবার্য বিস্ফোরণ। ২০১০-১১ তিন বছরে তিনটে ১০০ কোটির ছবি উপহার দিয়েছেন রোহিত। গোলমাল থ্রি, সিংহম আর বোল বচ্চন। নজর করলে দেখা যাবে একটা ‘থ্রি ইডিয়টস’ বা একটা ‘বরফি’ বাদ দিলে কিন্তু ১০০ কোটির ক্লাবে এ জাতীয় ছবিই বেশি। এমনকী ১০০ কোটির ধারা যে ছবি দিয়ে শুরু হয়, আমিরের ‘গজনি’ও তাই-ই এইট প্যাকের অ্যাকশন ফুলঝুরি। সলমন-অক্ষয়রা যে ধরনের ছবি করে রেকর্ড গড়েছেন দবং সিরিজ বা রাউডি রাঠৌর বোধবুদ্ধি সরিয়ে দেখতে আসা, পয়সা-উসুল মার্কা আমোদই তাদের মন্ত্র। শাহরুখও বিনোদন-গুরু রোহিতকে নিয়ে এই রাস্তায় হাঁটলেন। এবং হাতে হাতে ফল মিলল! বক্স অফিস বিশেষজ্ঞ তরণ আদর্শ স্পষ্ট বলছেন, “চেন্নাই এক্সপ্রেস সমালোচকদের খারাপ লাগলেও দর্শকের ভাল লেগেছে। বক্স অফিসে ওটাই শেষ কথা।” দেশের মাটিতে প্রথম সপ্তাহান্তে ১০০ কোটি। দেশের বাইরে আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান-সহ উপসাগরীয় দেশগুলির সর্বত্র প্রথম দিনেই রেকর্ড ব্যবসা করেছে ‘চেন্নাই’। আমেরিকায় শুক্রবার শাহরুখের সংগ্রহ ৭ লক্ষ ডলার, ব্রিটেনে ৬ লক্ষ ডলার। পাকিস্তানে ৩৬টা হল-এ শুধু নাইট শো-তেই এক দিনে ৮ লক্ষ ডলার। তার সঙ্গে যোগ করা যাক ৪৮ কোটি টাকায় বিক্রি হওয়া স্যাটেলাইট স্বত্ব আর নোকিয়া-ম্যাকডোনাল্ডের মতো মোট ১৮টি ব্র্যান্ডের সহযোগিতা (টাই-আপ) থেকে ৩০ কোটি টাকার রোজগার। “এই রেকর্ড ভাঙা কিন্তু শক্ত হবে,” বললেন তরণ।
এ রকম রেকর্ড যাতে হয়, তার জন্য চেষ্টার কসুর করেননি শাহরুখ। তাঁরই প্রযোজনা সংস্থা রেড চিলিজ-এর ব্যানারে তৈরি এই ছবির পরিবেশনার দায়িত্বে ছিল ইউটিভি। “দেশে ৩৭০০ আর বিদেশে ৭০০ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ‘চেন্নাই’। তার আগে বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে ছবির প্রচার করেছেন শাহরুখ। নিজের নানা ব্র্যান্ড-এর বিজ্ঞাপনে জুড়ে নিয়েছেন ‘চেন্নাই’-এর প্রসঙ্গ। তৈরি হয়েছে মোবাইল গেম” ছবির সাফল্যের পিছনে এই মার্কেটিং কৌশলকেও অনেকটা নম্বর দিচ্ছেন বলিউড-বিশেষজ্ঞ আমোদ মেহরা।
পাশাপাশি এও ঠিক, প্রচারে ঢিল দেওয়া শাহরুখের অভ্যাস নয়। তাঁর আগের ছবিগুলোর প্রচারেও কমতি ছিল না। চিনিটা তবু কম পড়ে যাচ্ছিল। দবং-টাইগার-বরফিদের দাপটে বাজিগরের ম্যাজিক ফিকে হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও উঠছিল। এত দিনে শাহরুখ জবাব দিলেন। সোমবারই টুইটারে লিখেছেন, “যদি গোলাপ হয়ে ফুটতে চাও, কাঁটার সঙ্গে ঘর করা শিখতে হবে চিনা প্রবাদ।”
বাদশাহি গোলাপের সুবাস বয়ে এনেছে ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’। |