কোলে শিশু, তাই কেউ তাঁকে তাড়া করবে না বলে ভেবেছিলেন কাটোয়ার পুঁইনি গ্রামের মনিকা রায়।
কিন্তু তেমনটা ঘটল না। মনিকার অভিযোগ, পুলিশের তাড়া খেয়ে আলপথ দিয়ে ছোটার সময়ে খেতজমিতে পড়ে যান তিনি। কোলের দেড় মাসের শিশু জলে পড়ে যায়। কোনও রকমে তাকে তুলে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে হাঁটাপথে মঙ্গলকোটের ধারসোনা মোড়, সেখান থেকে বাসে বাপেরবাড়ি মঙ্গলকোটেরই মাজিগ্রাম। শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিত্সা করানোর কোনও সুযোগই পাননি মনিকাদেবী। গত শনিবার মারা গিয়েছে শিশুটি।
সিপিএমের কাটোয়া জোনাল সম্পাদক অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় সোমবারই বর্ধমানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) তরুণ হালদারের কাছে পুরো ঘটনা জানিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি করেছেন। লিখিত অভিযোগে তিনি জানান, “ওই দম্পতি মৃত সন্তানের সত্কারের জন্য পুঁইনি গ্রামে ফিরে যান। তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন দুষ্কৃতীরা তাঁদের মৃত সন্তানকে কেড়ে নিয়ে মাটিতে পুঁতে দিতে বাধ্য করে এবং ওই দম্পতিকে তাড়িয়ে দেয়।” |
কাটোয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে আপাতত আত্মগোপন করে রয়েছেন মনিকা ও তাঁর স্বামী ভণ্ডুল রায়। তাঁদের অভিযোগ, স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের হাতে-পায়ে ধরে মৃত সন্তানকে নিয়ে তাঁরা গ্রামে ঢোকেন। গ্রামের বাইরে সেচখালের ধারে তাকে সমাধি দিয়েই তাঁদের গ্রাম ছাড়তে হয়। মনিকার অভিযোগ, “আমাদের সঙ্গে জনা দশেক আত্মীয়ও গ্রামে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভয়ে কেউই শেষ পর্যন্ত পাশে থাকতে পারেননি। গ্রামের কেউ প্রকাশ্যে সহানুভূতি দেখানোর সাহস পাননি।”
মোটরভ্যান চালক ভণ্ডুল আসলে জানতেন না তাঁর ছেলে অসুস্থ। ছেলে মারা যাওয়ার পরে খবর পান তিনি। তাঁদের একটি দু’বছরের মেয়েও রয়েছে। টানা বৃষ্টিতে ভিজে সে-ও অসুস্থ। তারও চিকিত্সা হয়নি। গোপন আস্তানায় বসে ভণ্ডুল প্রায় ফিসফিসিয়ে বলেন, “আমি আগেই পুলিশের তাড়া খেয়ে গ্রামছাড়া। তার পরে মনিকাও ছেলে নিয়ে পুলিশের ভয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। হাতে এক টাকাও ছিল না। মাজিগ্রামে গিয়ে মনিকা দেখে শ্বশুরমশাই শয্যাশায়ী। পরের দিন টাকাপয়সা ধার করে সে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়েছিল। ওঁরা বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু সে সুযোগ আর পেলাম কোথায়? ওদের জন্যই আমার কোলের ছেলে চলে গেল।”
ঘটনার সূত্রপাত গত ১ অগস্ট। সে দিন পুঁইনি গ্রামে গম ভাঙাতে গিয়েছিলেন পাশের সরগ্রামের বাসিন্দা তথা জেলা পরিষদের সদ্য নির্বাচিত সিপিএম সদস্য বিপত্তারণ মণ্ডল। তাঁর সঙ্গে গোলমাল বাধে তৃণমূল সমর্থকদের। পরের দিন প্রতিবাদ মিছিল করে সিপিএম। তৃণমূলের অভিযোগ, প্রতিবাদ মিছিলের নামে গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেয় সিপিএমের লোকেরা। পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্য তৃণমূলের তপতী দত্ত এবং আরও কয়েক জনের বাড়িতে ভাঙচুরও হয়। দু’পক্ষই বোমাবাজির অভিযোগ তোলে। পুলিশ যায়। সিপিএমের অভিযোগ, পুলিশ ও তৃণমূল মিলে গ্রামের সিপিএম ‘ঘাঁটি’ পশ্চিমপাড়ায় হামলা চালায়। ভয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন সিপিএম কর্মী-সমর্থকেরা।
কাটোয়া থানা সূত্রে জানা গিয়েছে, ভণ্ডুলের নামে মারধর ও হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। তৃণমূলের উপর হামলার অভিযোগে ভণ্ডুলের মা ধানুরানি রায় দশ দিন ধরে জেল হাজতে রয়েছেন। অসুস্থ হয়ে পুঁইনি গ্রামেই ছিলেন ভণ্ডুলের বাবা। যা পরিস্থিতি তাতে কোনও আত্মীয় তাঁদের একবেলার বেশি ঠাঁই দেবে না, সেই আশঙ্কা ছিলই। সোমবার সন্ধ্যার পরে বাবা এবং ভাইও গ্রামছাড়া হয়েছেন বলে খবর। পুঁইনি গ্রামের তৃণমূল নেতা উদয় সরকার অবশ্য বলেন, “শিশুমৃত্যু খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমরা ওদের গ্রামে এসে সত্কার করতে বলেছিলাম। মনিকাদেবীর শ্বশুর ও দেওর তো গ্রামেই আছেন।” বর্ধমান জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক মণ্ডল আজিজুল বলেন, “আমরা সিপিএমের মতো অমানবিক নই, যে শিশুমৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করব।” মনিকা বলেন, “ওরা আমার স্বামীকে তাড়াল। বাড়ির অন্য পুরুষেরাও পলাতক। ভেবেছিলাম, কোলে সন্তান রয়েছে, পুলিশ নিশ্চয় আমাকে তাড়া করবে না। এতেই আমার সর্বনাশ হয়ে গেল।” বর্ধমানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) তরুণ হালদার বলেন, “অভিযোগ হয়েছে শুনেছি। অভিযোগপত্র পড়ে ঘটনা খতিয়ে দেখব।” |