পুঞ্চ-কাণ্ডের পরেও কথা বন্ধে নারাজ ভারত
বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ সম্প্রতি একটি কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্য, স্নোডেন-প্রশ্নে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যদি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তাঁর পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করতে পারেন, তা হলে কেন পুঞ্চ-প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে সেপ্টেম্বরের সম্ভাব্য বৈঠক বাতিল করবেন না প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ?
মনমোহন অবশ্য এ ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পথ অনুসরণ করতে নারাজ। নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত-পাক সেনার মধ্যে যতই সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হোক, দাউদ ইব্রাহিমকে নিয়ে যতই বিতর্ক চলুক বা পাকিস্তান সম্পর্কে সরকারের নরম নীতির সমালোচনায় বিজেপি যতই সরব হোক, মনমোহন কিন্তু এখনও সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে নিউইয়র্কে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক বাতিল করতে চাইছেন না। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনার পথ বন্ধ করে দেওয়া মানে শুধু যে নিজেদের ক্ষোভ জানানোর পথ বন্ধ করে দেওয়া তা-ই নয়, কট্টরপন্থীদেরও প্রশ্রয় দেওয়া। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননও বলেন, “পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ যখন নিজে বৈঠকের দিনক্ষণ নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন, তখন শান্তি প্রক্রিয়ার চেষ্টাকে আবার শিকেয় তুলে রাখা মানে পাকিস্তানের কট্টরবাদীদের হাত শক্ত করা।”
শান্তি-অশান্তি
• শিমলা চুক্তি, জুলাই, ১৯৭২
• বাজপেয়ী-শরিফের উদ্যোগে লাহৌর বাসযাত্রা, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯
• বাজপেয়ী-মুশারফের আগরা সম্মেলন, জুলাই ২০০১
• ইসলামাবাদে যৌথ বিবৃতি, জানুয়ারি, ২০০৪
• মুম্বই হামলা, নভেম্বর, ২০০৮
• শর্ম অল শেখ-এ যৌথ বিবৃতি, জুলাই, ২০০৯
• মনমোহন-গিলানির থিম্পু বৈঠক, এপ্রিল, ২০১০
• নিয়ন্ত্রণরেখায় হামলা, পাঁচ ভারতীয় জওয়ানের মৃত্যু, অগস্ট, ২০১৩
কূটনীতিকরা মনে করাচ্ছেন, অতীতেও কট্টরবাদীরা ভারত-পাক শান্তি আলোচনা ভেস্তে দিতে সক্রিয় হয়েছে। ১৯৯৯ সালে নওয়াজ শরিফ শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করতে না করতেই তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ কার্গিলে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিলেন। সেই নওয়াজ ফের জনগণের ভোটে জিতে মসনদে এবং শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করতে আগ্রহী। আর ঠিক এই সময়টাতেই মাথাচাড়া দিচ্ছে কট্টরপন্থীরা। বর্তমান পাক সেনাপ্রধান পারভেজ কিয়ানি এ বছরের শেষের দিকে অবসর নেবেন। তাঁর জায়গায় নতুন সেনাপ্রধান বাছাইয়ের পর্ব শুরু হবে দ্রুত। তার আগে নওয়াজকে চাপে রাখতেই আইএসআই, সেনা ও জেহাদি মোল্লাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণরেখায় ফের সক্রিয় হয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দর কষাকষি করতে চাইছে। পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এ মামনুন হুসেন। তিনি প্রতিষ্ঠিত বস্ত্রব্যবসায়ী ও নওয়াজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মামনুন ও নওয়াজ দু’জনেই যখন ভারতের সঙ্গে সেপ্টেম্বরে আলোচনা শুরুর পক্ষে, তখন সেনা-আইএসআই ও জেহাদিরা তা ভেস্তে দিতে মরিয়া।
বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদের কথায়, “নওয়াজ শরিফকে আমাদের আরও সময় দিতে হবে। কারণ তিনি সবে ক্ষমতায় এসেছেন। এবং তিনি ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার পক্ষে। অতীতেও তিনি অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে লাহৌর বাসযাত্রার কূটনীতি করেছিলেন। সুতরাং এত অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর প্রতি অনাস্থাজ্ঞাপন সুষ্ঠু কূটনীতি নয়।” পাক কূটনীতিকরাও বলছেন, শরিফ ক্ষমতায় এসেছেন মাত্র ষাট দিন আগে। আর এই দু’মাসে সে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কমপক্ষে ৫৮টি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রবীণ পাক সাংবাদিক নাজাম শেঠি বলেন, “যেখানে জঙ্গিদের হাতে নওয়াজ নিজের ঘরেই আক্রান্ত, তখন তাঁকে ওই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য সময় দেওয়া প্রয়োজন।”
মনমোহন, সলমন খুরশিদরা শর্ম-অল শেখ-এর যৌথ বিবৃতিকে ভিত্তি করেই এগোতে চাইছেন। যে বিবৃতিতে দু’পক্ষই দু’পক্ষের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে শান্তি প্রক্রিয়ার দিকে এগোতে চেয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক দিনে নিয়ন্ত্রণরেখায় যে ভাবে গোলমাল চলছে, তাতে মনমোহন-সরকারের ঘরেই অন্য রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পাকিস্তান প্রশ্নে সলমনের বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে এ কে অ্যান্টনির প্রতিরক্ষা ও সুশীলকুমার শিন্দের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অভিযোগ, নরম বিদেশনীতিই সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দাদের মনোবল কমিয়ে দিচ্ছে। ‘মেরেছ কলসির কানা তা বলে কি প্রেম দেব না’ এই বিদেশনীতিই ভারতকে দুর্বল প্রতিপন্ন করছে।
মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটিতেও বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে। সেখানে সলমন যুক্তি দিয়েছেন, দু’টি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র আর যাই হোক, যুদ্ধ চাইতে পারে না। কাজেই মতপার্থক্য যাই হোক, আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে তার নিরসন করতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, জঙ্গি অনুপ্রবেশ হলে ভারতীয় সেনা বন্দুক ধরবে না। তাঁর বক্তব্য, সেনার প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল করতে প্রধানমন্ত্রী কখনওই পরামর্শ দেননি।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কে সি সিংহ ও জি পার্থসারথি দু’জনেই মনে করেন, সেপ্টেম্বরের বৈঠক হওয়া উচিত। কিন্তু তার আগে কোনও সমাধান সূত্রের প্রস্তাব নিয়ে ‘ব্যাক চ্যানেল’ কূটনীতি না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তাঁদের মতে, আগে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের আলোচনায় বসে বরফ গলানোর প্রক্রিয়া শুরু হোক। পাকিস্তান আগে নিজেদের ঘর সামলাক। ভারতের কোনও তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই। ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত, দু’দেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠক যেমন হওয়ার হোক। তা যদি কিছু দিন পিছিয়েই যায়, তা হলেও কোনও অসুবিধা নেই। নওয়াজ ও মনমোহনের বৈঠকেও যে কোনও সমাধানসূত্র নিয়ে আলোচনা করতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। শুধু একটি কথাই ভারত পাকিস্তানকে জানাতে চাইছে। তা হল, শান্তি প্রক্রিয়ায় ভারত-চিন মডেল অনুসরণ করা হোক। ওই মডেলটি হল, সীমান্ত বিবাদ নিয়ে দু’দেশের রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা নিয়ম করে আলোচনা চালাবেন। কিন্তু সেই সঙ্গে দু’দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক এবং মানুষে-মানুষে যোগাযোগ যেন স্বাভাবিক নিয়মে চলে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রককেও তাদের কাজ করে যেতে বলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তার মন্তব্য, “একেই বলা হয় রাবড়ি প্রক্রিয়া। নীচে আগুন আর উপরে ঠান্ডা হাওয়া। উপরে বিদেশ মন্ত্রক তাদের কাজ করবে। কিন্তু নীচে ছায়াযুদ্ধের মোকাবিলায় সেনা ও গোয়েন্দাদের তৎপর থাকতে হবে। সেনা সূত্রের বক্তব্য, গত ৬ অগস্টের পাক হামলায় ৫ জওয়ানের মৃত্যুর পরে সেনাপ্রধান বিক্রম সিংহ নাগরোটা সেনাছাউনি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। নিয়ন্ত্রণরেখায় আরও সেনা বাড়িয়ে পাল্টা আঘাত হানতে প্রস্তুত হচ্ছেন সেনাপ্রধান।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.