মৃতের নাম হাতের লেখা
সৈকত অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে আজ মহা ফ্যাসাদে পড়েছে। বাড়ির নেট ডাউন, তাই মেয়ের স্কুলে ভর্তির ফর্ম ভরতে হচ্ছে হাতে লিখে। অনলাইনে ফর্ম ফিল-আপ মুহূর্তে করে ফেলতে পারত। অথচ লিখতে বসে মনে হচ্ছে কী জঘন্য হাতের লেখা হয়েছে। আপার কেজিতে পড়া মেয়ে দেখলেও বোধ হয় হেসে ফেলবে। কম্পিউটারে লিখতে লিখতে এমন অবস্থা, সামান্য লিখেই হাত টনটন। আপনারও কি পেন-এর সঙ্গে বন্ধুত্বে অনেক দিন ছেদ পড়েছে? তা হলে দেরি না করে বরং তাড়াতাড়ি রি-ইউনিয়নের পর্বটা সেরে ফেলুন।

মোবাইলে মুদির লিস্ট
আগে সকালে বাজারে যেতেন যখন, বাড়িতে গিন্নি বলে দিতেন কী কী আনতে হবে। আপনি বুকপকেটের ছোট্ট নোটবুকে লিস্ট বানিয়ে নিতেন। আর এখন? বুকপকেট থেকে বের করেন আপনার মোবাইল, নোটস অপশনে গিয়ে চটপট লিখে ফেললেন। বাজারের খরচের হিসেবও দ্রুত সেরে ফেললেন মোবাইলেই। বাড়িতে অনুষ্ঠান। কাকে কাকে নেমন্তন্ন করা হবে, কার্ড পাঠানোর ঠিকানা, ক্যাটারার, ডেকরেটরের সুলুকসন্ধান সবই নিজের হাতে একটা বড় খাতায় লেখা হত। তাতে বার বার কাটাকুটি হত, কিছু ভুলও হত। আর এখন ও সবের বালাই নেই। আইপডে লিখছেন, ডিলিট করছেন নিমেষে। কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু হাতে লেখা প্রেমের চিঠি— তার কী হবে? সে সবও তো হয়ে যাচ্ছে এসএমএস-এ, চ্যাটে।

কেন নিজের হাতে লেখা দরকার
প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়বে, তাই বলে একান্ত ব্যক্তিগত একটা বিষয় ভুলে যাবেন, সেটা কোনও যুক্তিই হতে পারে না, মনে করেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। লেখার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বোধ, বুদ্ধি, বিচার, বিশ্লেষণ। সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার উপন্যাস, গল্প সবই হাতে লেখেন। লেখার সময়, কলম আর মন একাত্ম হয়ে যায়। বললেন, “কম্পিউটারকে আমি বলি, ‘কম পুট করে যে’।” কম্পিউটার কেজো যন্ত্র, তাকে যা বলা হবে, তা সে পালন করবে। উপন্যাস তো কেজো নয়, সেখানে মনের দরকার। “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি আঁকার সূত্রই ওই কাটাকুটি,” বললেন সমীর আইচ। আর্ট কলেজে পড়ার সময়, নেচার স্টাডি ক্লাসে যখন গাছের পাতা আঁকতে বলা হত তাঁদের, তখন শুধু পাতাটাই আঁকতেন না, আলোছায়ার আবহকেও ধরার চেষ্টা করতেন। নিজের হাতে লেখাও তাঁর কাছে অনেকটা সে রকমই। নাট্যকার ব্রাত্য বসু, সব সময় নিজের হাতে নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখেন। ভুল হলে, পাতা ফেলে দিয়ে আবার নতুন পাতায় লেখেন। “আমি কম্পিউটারে লিখতে গিয়ে দেখেছি, কেমন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। ওই প্যাশনটা ফুটে বেরোচ্ছে না।” কবি শ্রীজাত আবার নিজের কবিতার হাতে লেখা একটি পাণ্ডুলিপি অবশ্যই করে রাখেন। নিজের হাতে কবিতা বা গান লেখা, শ্রীজাতর কাছে অনেকটা প্রথম প্রেমের আদরের মতো। যা তিনি কোনও দিন ভুলতে চান না।
অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
কেন যন্ত্রের ওপর নির্ভর
পরিচালক, অভিনেতা পরমব্রত, স্ক্রিপ্ট লেখেন কম্পিউটারেই। ওঁর মতে, “এখন এত ভাল ভাল সফ্টওয়্যার আছে, তাঁর সাহায্যে লিখতে খুব সুবিধা হয়, এডিট করতেও।” যেমনই গল্প হোক বা সিন, আবেগগত ভাবে কোনও বাধাবিঘ্ন ঘটে না কম্পিউটারে লিখতে তাঁর। অভিনয় করার সময়ও কম্পিউটারে টাইপ করা স্ক্রিপ্টই পছন্দ। প্রয়োজনে, কোনও রেফারেন্স বা নোটস নিজের হাতে লিখে রাখেন স্ক্রিপ্টের পাশে। সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের মতে, কম্পিউটারে লেখা হবে কি না, তা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে অনেকটা। আজকের সমস্যা বা ভাবনা নিয়ে লিখতে গেলে, কম্পিউটারেই হয়তো লিখবেন তিনি। “কম্পিউটারে লিখলে কম শব্দে, বেশি কথা বলা যায়। হাতে লিখলে তার কিছুটা ব্যাপ্তি ঘটে। শ্রীজাত কবিতা লেখেন হাতে, কিন্তু বেশি শব্দের গল্প, প্রবন্ধ লেখেন কম্পিউটারেই। “আমি অলস প্রকৃতির, তাই পাঁচ-সাত হাজার শব্দের লেখা হাতে লিখে, আবার সেটাকে ফেয়ার করার মতো ইচ্ছে আমার হয় না,” বলছেন শ্রীজাত। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে যন্ত্রের সাহায্য তাই প্রয়োজনীয় তাঁর চোখে।

হাতের লেখা ভাল করার ইচ্ছে
ছোট থেকে কত বকাই না খেয়েছেন, হাতের লেখা ভাল করা নিয়ে। মনে পড়ে কারসিভ রাইটিং-এর বইগুলো? যার ওপর অনবরত হাত বোলাতে হত। ভুল হলে মা-বাবা ইরেজার দিয়ে মুছে দিতেন, আবার করতে হত। কী বিরক্ত লাগত তখন। মনে হত কী দরকার হাতের লেখা এত ভাল করার?
ক্লাস টুয়েলভে পড়ে নবারুণ। হাতের লেখা পরিষ্কার যাতে হয়, সে দিকে ও খুব খেয়াল রাখে, পাছে বুঝতে না পারলে পরীক্ষক নম্বর কাটেন। কিন্তু হাতের লেখা সুন্দর হল কি না, তা নিয়ে ওঁর অত মাথাব্যথা নেই। শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার, দীর্ঘ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় খেয়াল করেছেন, পরীক্ষার খাতাতে লেখার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের যত্ন কমেছে। খাতা দেখার সময়, তাই তিনি খুব বেশি আশাও করেন না। অক্ষরগুলো স্পষ্ট বোঝা গেলেই হল। শোনা যায় ‘চারুলতা’ তৈরির সময়, সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্টাইল অনুযায়ী লিখতে। অমলের চরিত্র করার সময়, তিনি সেই লেখার ছাঁচ অনুসরণ করেছিলেন। শোনা যায় শ্যুটিং শেষের পরও বহু দিন ওই ভাবেই লিখতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। হাতের লেখা দেখে নাকি মানুষ চেনা যায়। পরমব্রত মনে করলেন, সেই ক্লাস ফোরের কথা। সেই থেকে পেনে লেখা শুরু করেন। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতেন পেনে কালি ভরার প্রক্রিয়া। “কালির গন্ধে যেন কী একটা মাদকতা ছিল, প্রাণভরে গন্ধ নিতাম,” এখনও পরমব্রতর মনে পড়ে সেই সুখস্মৃতি, যখন এক বন্ধু তাকে এসে বলেছিল, দারুণ এক পেনের কথা, যার নাম ‘মঁ ব্লাঁ’। এখন তো কত রঙের কালির পেন হয়।

পেন আর সৃষ্টি
কবি ও গীতিকার শ্রীজাত বলছেন, “ওই পেন আমার কবিতার সঙ্গী, অনুভুতির সঙ্গী, ঠিক বন্ধুর মতো।” পেনের প্রতি অদম্য ভালবাসা থেকেই, প্রচুর পেন সংগ্রহ করে ফেলেছেন নয়াদিল্লি নিবাসী বিক্রম সেন একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্ণধার। পৃথিবীর যে প্রান্তেই বেড়াতে যান না কেন, সেখানকার পেন তাঁর সংগ্রহে জায়গা করে নেয়। তাঁর সংগ্রহে নবতম সংযোজন ফেরারির লিমিটেড এডিশন পেন, যা গত বছর ইতালি থেকে নিয়ে এসেছেন। ওঁর মতে, পকেটে একটা দারুণ পেন থাকার মধ্যে বেশ একটা ভাললাগা আছে। নিজে বিজ্ঞাপন জগতের সঙ্গে জড়িয়ে বহু বছর, অথচ বিস্মিত হন যখন দেখেন কলমের বিজ্ঞাপনের চাহিদা এত কম। মাঝে মাঝে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার অত্যন্ত মূল্যবান কলমগুলি দিয়ে লেখেন, রক্ষণাবেক্ষণ করেন সেগুলির। এই কাজ করে পরম তৃপ্তি পান তিনি।

চিঠি লেখা
সবার চোখ লুকিয়ে ভালোবাসার মানুষকে মনের কথা বলা বা বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিত সবার সঙ্গে গল্প, খোঁজখবর নেওয়া, এই সব ব্যাপারে এক সময় চিঠিই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। এখন আরও অনেক উপায় আছে ঠিকই কিন্তু হাতে লেখা চিঠির আবেদনকে ‘রিপ্লেস’ করা বোধহয় সম্ভব নয়। “হাতে লেখা চিঠি পড়ে, চিঠির প্রেরকের মুখখানা চোখে ভেসে ওঠে, চিঠির বিষয়ও সব জীবন্ত হয়ে ওঠে, মেল পড়ে এই রকম অনুভুতি হয় না।” বলছেন সমরেশ মজুমদার। একটি মেয়ে তাঁকে একটি প্রেমপত্র পাঠিয়েছেন কিছু দিন আগে। তাতে লেখা এলভি। ‘লভ’-এর ছোট ফর্ম যে এটা, বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে! হাতে লেখা চিঠিতে মনের ভাব যেভাবে প্রকাশ পায়, ই-মেলে তার চেয়ে অনেকটা কম, আর এসএমএস-য়ে সেটা কেমন যেন কেজো কথার মতো শোনায়। তাই হাতে লেখা চিঠি পেলে, মন ভরে যায় পবিত্র সরকারের। তিনি নিজে এখনও বিজয়া, নববর্ষের শুভেচ্ছা, নিজের হাতে লিখেই পাঠান।
আপনার ব্যস্ত জীবনের মাঝে এক চিলতে সময় বের করে দেখুন তো আপনার বহু দিনের পুরনো অভ্যাস আবার ফিরিয়ে আনতে পারেন কি না। ভুলে গিয়েছেন, এক সময় আপনি নিয়মিত ডায়রি লিখতেন, চিঠি লিখতেন। পুরনো বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দিন না, হঠাৎ চিঠি পাঠিয়ে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.