চার বার। মাত্র তিন মাস বয়সে চার চার বার আগুনে পুড়েছে ছোট্ট শরীরটা। শেষ বারের আঘাত এতটাই গুরুতর যে তার জেরে গত মাস থেকে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে দিন কাটাচ্ছে রাহুল। আর তাকে ঘিরে দিন কাটছে বিস্মিত চিকিৎসক মহলের। কারণ? পোশাকি পরিভাষায় ‘স্পনটেনিয়াস হিউম্যান কমবাশন’-এর মতো রহস্যজনক ‘রোগের’ শিকার মাস তিনেকের খুদে রাহুল। এমন একটি রোগ যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়েই রয়েছে প্রশ্ন।
‘স্পনটেনিয়াস হিউম্যান কমবাশন’ বা সংক্ষেপে ‘এসএইচসি’ ঠিক কী?
কারও কারও মতে, স্বল্প কিছু ক্ষেত্রে শরীরের ভিতরের নানা রকমের রাসায়নিক যোগ-বিয়োগের ফলে তৈরি হয় আগুনের ফুলকি। আর সেই ফুলকিতেই ঝলসে যায় দেহাংশ। সোজা ভাষায়, দেহের ভিতরের রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে ত্বকের উপরিভাগে আগুন ধরে যায় আপনাআপনি। যা থেকে জ্বলে যেতে পারে দেহাংশ। তামিলনাড়ুর রাহুলের ক্ষেত্রে খানিকটা সে রকমই হয়েছে বলে দাবি তাঁর মায়ের।
রাহুলের মা রাজেশ্বরীর দাবি, জন্ম থেকে মাঝে মধ্যেই এ ধরনের ‘আত্মদহন’-এর যন্ত্রণা পেয়েছে রাহুল। এর মধ্যে সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে মাসখানেক আগে। প্রথমে তাকে ভর্তি করা হয় পুদুচেরির ‘জওহরলাল ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চে’(জেআইপিএমইআর)। পরে চেন্নাইয়ের কিলপউক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেই চিকিৎসা চলছে রাহুলের। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আপাতত তার অবস্থা স্থিতিশীল। যদিও এখনও কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রে রাখা হয়েছে তাকে। চিকিৎসকদের অবশ্য আশা, আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে রাহুলকে।
তবে তার চিকিৎসা কোন পথে এগোবে, সে নিয়ে কিছুটা চিন্তিত চিকিৎসকেরা। আসলে এসএইচসি-র অস্তিত্ব নিয়েই ধন্দে চিকিৎসাবিজ্ঞান। এমনকী এখনও পর্যন্ত কোনও সর্বজনসম্মত ব্যাখ্যাও মেলেনি এর। কারও কারও মতে, পরিপাক প্রক্রিয়ার জেরে অন্ত্রে তৈরি হওয়া মিথেন গ্যাস যখন রোমকূপের ভিতর দিয়ে বাইরে বেরোতে থাকে, তখন তা যদি সিল্ক বা ওই জাতীয় বিশেষ কোনও পদার্থের সংস্পর্শে আসে, সে ক্ষেত্রে তৈরি হতে পারে স্থির-তড়িৎ। আর তার থেকে সৃষ্টি হতে পারে আগুনের ফুলকি। জ্বলতে পারে ত্বকের উপরিভাগ। আবার আর এক মহলের ব্যাখ্যা, রক্তে কোনও কারণে অ্যালকোহলের পরিমাণ বিপুল বেড়ে গেলে এ হেন ঘটনা ঘটতে পারে। কেউ কেউ আবার এর জন্য দায়ী করছেন শরীরে কোনও বিশেষ ধরনের গ্যাসের পরিমাণের বেড়ে যাওয়াকে।
তবে, অনেকের মতে, মদ্যপ অবস্থাও বহু সময় এ ধরনের ক্ষতের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। যেমনভারসাম্য না রাখতে পেরে হাতের সিগারেট ফসকে জামাকাপড়ে পড়ে যাওয়া, কিংবা ফায়ারপ্লেস থেকে দুর্ঘটনা। দুটি ক্ষেত্রেই অবশ্য আগুনের উৎস শরীরের বাইরের কোনও বস্তু। যা এসএইচসি-র মূল বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে খাপ খায় না। কলকাতার বিশিষ্ট গ্যাস্ট্রোএনট্রোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর মতে, অন্ত্রের পরিপাক থেকে তৈরি হওয়া মিথেন এবং তার থেকে আগুনের ফুলকির সৃষ্টি চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাতায় এ হেন কোনও ব্যাখ্যার অস্তিত্ব নেই। তাঁর সংশয়, “এ ধরনের গল্প তৈরি করা হয় মূলত মানুষের কুকীর্তির উপর বিজ্ঞানের মুখোশ লাগাতে। মানুষের অপরাধই এ রোগের উৎস।”
রাহুলের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার কোনও মেডিক্যাল রেকর্ড নেই। এমনকী, জেআইপিএমইআর-এ প্রথমে যে ভর্তি হয়েছিল সে, তারও কোনও নথি নেই। পুরোটাই রাহুলের মায়ের বয়ান। চিকিৎসকরা অবশ্য ক্ষতের উৎস খুঁজতে শুরু করেছেন নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা।
যদিও রহস্যজনক ‘আত্মদহন’ তত্ত্ব ইতিমধ্যেই প্রশ্নের মুখে। |