|
|
|
|
স্মরণ |
দেয়া নেয়া ৫০
শ্যামল মিত্র ২৫ |
ছায়াছবির অর্ধশতক। তবু মায়াবিনী সুরের সেই সব গান আজও যেন কুহকিনী।
সুরকার শ্যামল মিত্রের ২৫তম প্রয়াণবর্ষে ফিরে দেখলেন কৃশানু ভট্টাচার্য |
মুম্বইয়ের আকাশেও সে দিন শ্রাবণের ঘনঘটা। তুমুল বৃষ্টি। দূরভাষে ফেলে আসা দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই তাই মূহূর্তে তাঁর মনেও মেঘের মেলা। স্মৃতি তো সর্বদাই বেদনার।
‘দেয়া নেয়া’ ছবির প্রসঙ্গ উঠতেই আরতি মুখোপাধ্যায় যেন পৌঁছে গেলেন অর্ধ শতাব্দী আগের সেই মায়াবিনী সুরের সাদাকালো দিনে। “পঞ্চাশ বছর আগে ‘দেয়া নেয়া’ মুক্তি পেয়েছিল?” নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না।
‘মাধবী মধুপে হল মিতালি’ গানটি গেয়েই বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে নাম হয়েছিল আরতির। “তখন আমি খুবই ছোট। নিজেও বুঝিনি গানটি এমন হিট হবে! আর শুধু এই গানটিই নয়। ‘দেয়া নেয়া’র সব গানই সুপার হিট হয়েছিল। কী সুরই না দিয়েছিলেন শ্যামলদা।”
এই গানটির জন্য আরতির নাম প্রস্তাব করেছিলেন ভূপেন হাজারিকা। ‘মার্ফি অল ইন্ডিয়া রেডিও কনটেস্ট’-এ আরতি প্রথম হয়েছিলেন। আর ভূপেনদা ছিলেন সেই প্রতিযোগিতার বিচারক, জানালেন শ্যামল অনুজ সলিল মিত্র।
“ওই অল্প বয়সেই আরতিদি সি-শার্পে শুরু করে উপরে মধ্যমপঞ্চম টাচ করে ফিরে আসতে পারতেন। কোনও ‘ফিমেল’ গায়িকার পক্ষে এটা করা রীতিমতো কঠিন কাজ। খুব ট্যালেন্টেড ছিলেন,” জানালেন সলিলবাবু।
“আসলে আমার দাদার জীবনকথা নিয়েই ‘দেয়া নেয়া’র কাহিনি।” নৈহাটির বিশিষ্ট চিকিৎসক সাধনকুমার মিত্র নিজে ছিলেন এক জন দক্ষ এস্রাজবাদক। “আর কাকা ছিলেন ক্লাসিক গায়ক। কাজেই সঙ্গীত আমাদের রক্তেই,” গর্বের সঙ্গে দাবি করলেন সলিলবাবু।
এ সত্ত্বেও সাধনবাবু কখনও চাননি যে, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র শ্যামল চিকিৎসক না-হয়ে গায়ক হোন। “কিন্তু যাঁর স্বপ্ন গায়ক হওয়ার, তাঁকে আটকায় কে? নৈহাটির প্রাসাদোপম বাড়ি ছেড়ে বাবা চলে এলেন কলকাতায়”, স্টুডিয়োতে কাজের অবসরে স্মৃতিচারণে মুখর হলেন প্রয়াত সুরকার-গায়কের কনিষ্ঠ পুত্র সৈকত। জানালেন, কী ভাবে অক্লান্ত লড়াই করে বাংলা সঙ্গীত জগতে অন্যতম উজ্জ্বল তারকা হয়ে ফুটে উঠেছিলেন শ্যামল মিত্র।
‘দেয়া নেয়া’-র নায়ক হিসেবে উত্তমকুমারকে ছাড়া আর কারও কথা কী করেই বা মনে আসবে প্রযোজক শ্যামল মিত্রের? ‘‘দু’জনের রসায়ন ছিল দেখার মতো”, জানালেন সলিলবাবু।
কিন্তু নায়িকার সন্ধানে অনুজকে নিয়ে শ্যামলবাবু পাড়ি দিয়েছিলেন তখনকার বোম্বেতে। প্রথমে শর্মিলা ঠাকুর এবং আশা পারেখ ডেট দিতে না পারায় নূতনকে রাজি করানোর জন্য তাঁরা পৌঁছে গিয়েছিলেন নায়িকার মা শোভনা সমর্থের বাড়ি। “কিন্তু নূতনও ডেট দিতে পারলেন না। ওই সময়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসছিলেন শোভনার ছোট মেয়ে তনুজা। স্কার্ট আর টপ পরা ফুটফুটে সুন্দরী, হিন্দি ছবিতে নবাগতা তনুজাকে দেখেই বাবার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল”, জানালেন সৈকত।
নির্দিষ্ট দিনে তনুজা পৌঁছে গেলেন কলকাতায়। শুরু হল শ্যুটিং। আর তার পর পুরোটাই ইতিহাস। সুপারডুপার হিট হল ওই ছবি। শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে’ বা ‘আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন’। |
|
দেয়া নেয়া |
আর ‘দোলে দোদুল দোলে দুলোনা’? “এই গানের সরগম মানবদা করেছিলেন। পেমেন্ট ভাউচার ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে দাদাকে মানবদা কী বলেছিলেন জানেন? “শ্যামল, টাকা দিয়ে এ গান কেনা যায় না। তুই আমি চলে যাওয়ার পরেও এই গান থাকবে”, দাদার নিত্য ছায়াসঙ্গী সলিলবাবু সেই অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী ভোলেন কী করে?
মুক্তির পরে ‘দেয়া নেয়া’ পেরিয়ে গেল অর্ধ শতক। কিন্তু শুধু কি এই ছবির জন্যই বাংলা ছবির দর্শকেরা মনে রাখবেন প্রয়াত সুরকার শ্যামল মিত্রকে?
বাংলা সঙ্গীত জগতে নিজের প্রতিভার পরিচয় রাখার পরে বাংলা ছবিতেও অপরিহার্য হয়ে উঠলেন শ্যামল। ‘দেয়া নেয়া’ ছিল তাঁর নবম ছবি।
“সারা ভারতে সলিল জেঠু, হেমন্ত জেঠুর পরেই বাঙালি সুরকার হিসেবে নাম করেছিলেন আমার বাবা”, দাবি করলেন সৈকত। সব রকমের গানেই ছিল তাঁর অনায়াস বিচরণ। “আধুনিক গানের শিল্পী হলেও রাগাশ্রয়ী গানেও বাবা ছিলেন একই রকমের সাবলীল।” উদাহরণ কলাবতী রাগে ‘ডেকো না মোরে ডেকো না’ গানটি।
শ্যামল মিত্রের সুরে ‘আমি সে ও সখা’ ছবিতে ‘এমন স্বপ্ন দেখিনি তো আগে’ গাওয়ার রোমাঞ্চ এখনও ভুলতে পারেননি হৈমন্তী শুক্ল। “তখনও অভিজ্ঞ হইনি। কিন্তু শ্যামলদা কোনও দিন মাস্টারি করতেন না। শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করতেন সহজ মধুর সুরে।”
দক্ষ সুরকারের সব গুণই তাঁর ছিল। হেমন্তদার মতোই জানতেন সিচুয়েশন অনুযায়ী কোন শিল্পীকে দিয়ে কোন গানটি গাওয়াতে হবে। “আর সুযোগ দিতেন নতুনদের”, হৈমন্তীর অকপট স্বীকারোক্তি।
সঙ্গীতের ‘রেঞ্জ’ এবং ‘ভ্যারিয়েশনে’ হেমন্তদা-নচিদা-সুধীনদা ছাড়া সুরকার হিসেবে শ্যামলদার ধারেকাছে কেউ নেই, মন্তব্য শ্রীকান্ত আচার্যের। তাঁর মতে, চলচ্চিত্রে সুরকার হিসেবে শ্যামল মিত্রের প্রায় ৯০ শতাংশ গান হিট। “অনবদ্য তাঁর ট্র্যাক রেকর্ড।” সে কথা আর বলতে! না-হলে ‘অমানুষ’ বা ‘আনন্দ আশ্রম’-এর গানের আবেদন শ্রোতাদের কাছে আজও অমলিন থাকে কী করে? |
সঙ্গতে মহানায়ক |
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে
|
ছবি সৌজন্য: মন্টু বসু |
|
বাংলা গানের এখনকার জনপ্রিয় শিল্পী মনোময় ভট্টাচার্যের মতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও শ্যামল মিত্রের অনেক দিক জানা ছিল। “না-হলে ‘দোলে দোদুল দোলে’র মতো গানের সুর করা সম্ভব ছিল না। তরুণকুমারের লিপে মান্নাদাকে দিয়েও গাওয়াতে পারতেন। কিন্তু অতিরঞ্জিত মনে হত ভেবেই বোধহয় তা করেননি। এই কারণেই শ্যামলদা অনবদ্য।”
মনোময়ের আক্ষেপ, “ছবির পর ছবিতে সুর দিয়েই শ্যামলদা যে-ছবি আঁকতেন, আজ আর কি তা সম্ভব?”
মুম্বইয়ে হিন্দি অ্যালবাম করতে এসে শ্রীকান্ত উপলব্ধি করেছেন, এখানকার সঙ্গীত জগতের মানুষজন কতটা ‘অ্যাডমায়ার’ করেন শ্যামল মিত্রকে। “তুল্যমূল্য বিচারে শ্যামলদাকে পিছিয়ে রাখা যাবে না। কারণ তিনি বলিউডের মতো বড় ফিল্ডেও কাজ করেছেন।” শ্রীকান্তের মতে, ছবির কমার্শিয়াল সাইডও শ্যামলবাবু দারুণ বুঝতেন। না-হলে কি আর শক্তি সামন্তের ছবিতে ডাক পেতেন?
শ্যামল মিত্রের ন্যাজাল টোন সত্ত্বেও তাঁর কণ্ঠের ‘ডেপথ’-এর জন্যই ‘গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে’র মতো মেলোডিয়াস সুর অনায়াসে ভরিয়ে দিত শ্রোতাদের মনপ্রাণ”, মন্তব্য করলেন গায়ক জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়।
“আসলে গায়ক বা সুরকার হিসেবে ‘ফোক’ সঙ্গীতে বাবার দক্ষতা ছিল সহজাত” বলে মনে করেন সৈকত। তাঁর মতে, ‘যেমন শ্রীরাধা কাঁদে’ বা ‘রাজার পঙ্খী উইড়া গেলে’র মতো গানেই হোক, বা ‘বনপলাশির পদাবলী’-তে ‘দেখুক পাড়াপড়শিতে’ বাংলার পল্লিমাটির সহজিয়া টান থাকত তাঁর গানে এবং সুরে”।
সৈকতের কথায় ঘুরেফিরে এল শ্যামল মিত্রের অনবদ্য গায়কির প্রসঙ্গ, “‘এফোর্টলেস’। শুনলে মনে হবে গান গাওয়ার মতো সহজ আর কিছু হয় না।”
সলিল চৌধুরীর সুরে ‘আহা ওই আঁকাবাঁকা যে পথ’ গেয়েছিলেন শ্যামলবাবু। পরে সেই গানই হিন্দিতে গান তালাত মামুদ। “কিন্তু বাবার মতো হয়নি,’’ দাবি সৈকতের।
সুরকার শ্যামল মিত্রের সুরের আর একটি দিক চিহ্নিত করেছিলেন আশা ভোঁসলে। গানের আলোচনায় তিনি সৈকতকে বলেছিলেন, বাইজিবাড়ির গানে যে-ধারা শ্যামলদা বাংলা ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন, তা খুব বেশি শোনা যায় না। যেমন ‘অমানুষ’ ছবিতে ‘না না অমন করে দাগা দিয়ে চলে যেও না’ গানটি। |
|
আরতি মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, কিশোরকুমার |
সঞ্চারীর যে ধারা সুধীরলাল চক্রবর্তী শুরু করেছিলেন, আদর্শ ছাত্র হিসেবে চিরকালই তা হুবহু অনুসরণ করেছিলেন শ্যামল মিত্র। “সঞ্চারীর সুর সৃষ্টিতে বাবা ছিলেন অতুলনীয়।” গান লেখা হয়ে গেলে সুর করতে তাঁর সময় লাগত না। “হারমোনিয়াম বাজল মানে সেটাই সুর। আত্মবিশ্বাস কাকে বলে,” প্রয়াত বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ঝরে পড়ল সৈকতের কণ্ঠ থেকে।
‘দেয়া নেয়া’, ‘অমানুষ’ ‘অজস্র ধন্যবাদ’, ‘রাজকন্যা’, ‘বনপলাশির পদাবলী’ অজস্র ছবি, অসংখ্য সুর। ‘বিপিনবাবুর কারণ সুধা’, ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর ’থেকে ‘নওলকিশোর শ্যামসুন্দর’ থেকে ‘এ যেন অজানা এক পথ’। গানে গানে ভুবন ভরিয়ে দিলেও “তাঁর সুরে বিদেশি প্রভাব দেখা যেত না”, জানালেন শ্যামল-পুত্র সৈকতের।
হিন্দি বাংলা মিলিয়ে শ্যামল মিত্রের সুরারোপিত ছবির সংখ্যা কত জানেন? ৪৬। ভাবা যায়?
“হেমন্তদার, সলিলদার মতোই সর্বভারতীয় স্তরেও সফল শ্যামলদা”, মানছেন আরতি। “তুলনা না-করে বলতে পারি, সুধীনদা যেমন ওয়েস্টার্ন এবং ইন্ডিয়ান ক্লাসিকে দক্ষ ছিলেন, শ্যামলদা তেমনই মেলোডিয়াস।”
ভীমসেন জোশীর কাছ থেকে ভাটিয়া রাগের প্রয়োগ শিখে শ্যামল মিত্র তৈরি করেছিলেন ‘তরীখানি ভাসিয়ে দিলাম ওই কূলে’। “অনবদ্য সে গান। গীতিকার ছিলেন পবিত্র মিত্র। আসলে দাদা ছিল শ্রুতিধর। সুর একবার শুনলেই তুলে নিতে পারত”, অগ্রজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সলিল মিত্র।
বাংলা গানের স্বর্ণযুগের শিল্পীরা আজ কোথায়? সম্ভব উজ্জ্বল সেই অতীতকে ফিরিয়ে আনা? আক্ষেপ ঝরে পড়ল আরতির কণ্ঠে, “কী ভাবে যে দিনগুলো কেটে গেল।”
শ্রোতারা একমত? স্বর্ণযুগ আর ফিরে আসবে না? যা হয়ে গিয়েছে তা আর সম্ভব নয়? |
|
|
|
|
|