শনিবারের নিবন্ধ
‘স্যার’ সলমন খান
দি বলি সলমন খানের মামার বাড়ি মুর্শিদাবাদের একটি গ্রামে, অবাক হবেন তো?
যদি বলি, বিল গেটস বলেছেন উনি সলমন খানকে হিংসে করেন, তাহলে নির্ঘাত মনে মনে প্রশ্ন করবেন, আমেরিকার এই শিল্পপতি কবে থেকে আবার হিন্দি সিনেমা দেখতে শুরু করলেন?
যদি বলি, ‘টাইম’ পত্রিকা পৃথিবীর একশো জন ক্ষমতাবান মানুষের তালিকায় সলমন খানকে রেখেছেন, তা হলে নিশ্চয়ই ভাববেন, কী করে এই খবরটা এখানকার ফিল্ম জার্নালিস্টদের চোখ এড়িয়ে গেল?
অথচ বিশ্বাস করুন, এই তিনটি তথ্যের কোথাও এতটুকু ‘জল’ নেই।
সলমন খান। বয়স ছত্রিশ। বাবার আদি বাড়ি বরিশাল। মা বড় হয়েছেন মুর্শিদাবাদে। সলমনের জন্ম অবশ্য নিউ অরলিয়ন্স-য়ে। তার পর ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে এমএস করে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে ম্যানেজমেন্ট পাস করেন। বেশ কিছু বছর ‘হেজ অ্যানালিস্ট’ হিসেবে কাজ করার পর হঠাৎ এক অদ্ভুত খেয়াল চাপে ওঁর। ভেবে বসেন, বাচ্চাদের অঙ্ক আর বিজ্ঞান শেখানোর পদ্ধতিতে যদি নতুন কিছু করা যায়। এর পরই তিনি শুরু করেন ‘খান অ্যাকাডেমি’। যার ছায়ায় পৃথিবীর কোটি কোটি বাচ্চাকে ইন্টারনেটে ভিডিয়ো-র মাধ্যমে বিনামূল্যে শিক্ষা দিতে থাকেন তিনি। এ বছর মে মাস অবধি ইউ টিউবে তাঁর ভিডিয়ো দেখে ফেলেছেন প্রায় ২৮৩ মিলিয়ন খুদে পড়ুয়া!
ক্যালিফোর্নিয়ায় ফোনে যখন প্রথম ধরা গেল ওঁকে, প্রশ্ন ছিল “বাংলা বলতে পারেন?” ও প্রান্ত থেকে ভাঙা ভাঙা বাংলায় উত্তর এল, “একটু একটু পারি।” তারপরই হই হই হাসির আওয়াজ। ইংরেজিতে যে ভিডিয়োগুলো ‘আপলোড’ করা আছে, তার প্রত্যেকটা ‘ভয়েসওভার’ই সলমনের নিজের। সম্প্রতি বাংলাতেও তাঁর অ্যাকাডেমির ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে গলাটা ...? কথা শেষ হওয়ার আগেই সলমন বললেন, “না না, ওটা আমার গলা নয়।”
ছবি: সৌজন্য রন সিডেনগ্লানজ্
বাংলা ভাল বলতে না পারলে কী হবে, বাঙালিয়ানা কিছু কম নেই তাঁর মধ্যে। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখেছেন। নিউ অরলিয়ন্সে বড় হয়েও প্রতি রবিবার কাঁটা বেছে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার অভ্যাস ছিল। ঢাকা বেড়াতে গিয়েছেন প্রায় বছর আষ্টেক আগে। ভারতে অনেক বার এলেও এখনও কলকাতা দেখা হয়নি। ওঁর মা মাসুদা অবশ্য মুর্শিদাবাদ গেলে কলকাতা হয়েই যান। সলমনের বড় ইচ্ছে, পরের বার এ দিকে এলে একবার অন্তত কলকাতা ঘুরে যাবেন।
হঠাৎ ভিডিয়ো বানানোর শখটা হল কী করে? “আমি তখন চাকরি করতাম বস্টনে। ২০০৪ সাল নাগাদ, আমার এক সম্পর্কিত বোন নাদিয়া নিউ অরলিয়ন্স থেকে একদিন হঠাৎ ফোন করল। বলল, ওর অঙ্ক কষতে গিয়ে বেশ কিছু অসুবিধে হচ্ছে। এই কথা শুনে ঠিক করলাম ওকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভিডিয়ো বানিয়ে পড়াব। তো তাই শুরু করলাম। তাতে কাজও দিল বেশ ভাল। আমার সেই বোনের দেখাদেখি আরও দু’জন ভাই ওই একই পদ্ধতিতে পড়তে শুরু করল,” বলছিলেন সলমন।
রাতারাতি সলমন হয়ে উঠলেন ‘অন লাইন মাস্টারদা’। ২০০৬ নাগাদ আরও একটু বড় করে ভাবতে শুরু করলেন তিনি। কেমন হয়, যদি অন্য অনেক বাচ্চাকে শেখানো যায় এই একই পদ্ধতিতে?
ভাবামাত্র শুরু করে দিলেন কাজ। “কেউ কেউ ভাবত, আমি একেবারে বদ্ধ পাগল। কেউ বলত, এত সব কিছু সামলাবে কী করে? তখনও আমি চাকরি করি। সেখানে টাকাপয়সাও বেশ ভাল। এমনকী আমার অফিসের কাজটা যে ভাল লাগত না, তা’ও নয়। তবু স্বপ্ন দেখতাম ভিডিয়োগুলোকে নিয়ে।”
এর পর একদিন কিছুটা হালকাছলেই ভেবে ফেলেন, একটা অ্যাকাডেমি করবেন। ওঁর স্ত্রী উমাইমা মারভি ডাক্তারির ফেলোশিপ পেতেন তখন। এ ছাড়া ছিল জমানো কিছু টাকা। তা দিয়ে দু’বছর অনায়াসে চালিয়ে নেওয়া যাবে। চাকরি ছাড়লেন। আর ডুব দিলেন নানা ধরনের ভিডিয়ো বানানোর নেশায়। এ দিকে ছেলেমেয়েই অনেক বাচ্চাই তাঁর ভিডিয়ো দেখে পড়তে শুরু করল। তখনই ছোটখাটো ‘গ্র্যান্ট’ও আসছে। “কিন্তু এ সব দিয়ে এত বড় একটা সংস্থা চালানো কিছুতেই সম্ভব না। নিজের সেভিংস থেকে প্রত্যেক মাসে সাড়ে চার হাজার ডলার করে খরচা করছিলাম। হঠাৎ একদিন একটা চেক এল দশ হাজার ডলারের। চেকটি পাঠিয়েছিলেন অ্যান ডয়্যার। পৃথিবীর অন্যতম সফল ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট’ জন ডয়্যারের স্ত্রী অ্যান। চেক পাঠিয়ে বললেন, “যদি লাঞ্চ করি একসঙ্গে।”
ভারতীয় একটা রেস্তোরাঁয় লাঞ্চে গিয়েই বোধহয় সলমনের জীবনের মোড়টা ঘুরে যায়। ওখানেই শোনেন, অ্যানও সলমনের ভিডিয়োর ভক্ত। এর কয়েক মাস পরে অ্যান ফোন করে বলেন, অ্যাসপেন আইডিয়াজ উৎসবে বিল গেটস নাকি প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন যে তাঁর বাচ্চাদের তিনি অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়ান সলমনের ভিডিয়োর সাহায্য নিয়ে।
“আমি কল্পনা করতে পারিনি যে এটা হওয়া সম্ভব ছিল। ছোটবেলা থেকেই বিল গেটসের সম্পর্কে পড়েছি। আর সেই বিল গেটস কিনা বলছেন, আমাকে হিংসে করেন! বিলের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগের রাতে ভেবেছি, গিয়ে কী বলব। মগজ আর মনের মধ্যে একটা যুদ্ধ চলছিল। বিল গেটসকে সামনাসামনি দেখে একেবারে বাক্রুদ্ধ। মনের আশি শতাংশ তখন বলছে, এই স্পেশাল মুহূতর্টা যেন পুরোপুরি উপভোগ করি আমি। আর বাকি কুড়ি শতাংশ চেষ্টা করছিল যাতে ঠিকমতো কথা বলতে পারি। মাইক্রোসফটে আমার বন্ধুরা ছিল। তাদের মুখে শুনেছি যে বিল গেটস বেশ মুখের ওপর সত্যি কথা বলে দিতে পছন্দ করেন। ভাবলাম যদি ঘেঁটে যায় তবে ওখানেই সব শেষ।”
এমআইটি-তে ক্লিন্টনের কাছ থেকে ডিপ্লোমা নিচ্ছেন সলমন
কিন্তু না। তা হয়নি। বিল গেটস সলমনের কাজে আর্থিক সাহায্য করলেন। গুগলও এগিয়ে এল তাঁর সাহায্যার্থে। ‘ফরচুন’ পত্রিকাতে প্রকাশিত সলমনকে নিয়ে একটা লেখার শিরোনাম ছিল ‘বিল গেটস ফেবারিট টিচার’। আর সেই প্রতিবেদন পড়েই অনেকে নড়েচড়ে বসলেন। এমনকী পুরনো আত্মীয়দের কাছ থেকে ই-মেল আসা শুরু হল।
খ্যাতি এসেছে। তার সঙ্গে ক্ষমতাও। তবে ছিদ্রান্বেষীরা কিন্তু থেমে থাকেননি। কটাক্ষ করে বলেছেন যে সলমনের কাজটা তো পুরোটাই উইকিপিডিয়ার উপর ভিত্তি করে। শিক্ষকরা বলেছেন যে সলমনের ভিডিয়ো তাঁদের জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করছে। “শিক্ষক আর অভিভাবকদের জায়গা ভিডিয়ো নিতে পারবে না। বরং তাঁদের ‘এমপাওয়ার’ করবে আমার ভিডিয়োগুলোও। আমার কাজটা সম্পূর্ণ ভাবে উইকিপিডিয়াভিত্তিক নয়। উইকিপিডিয়ার আর্টিকেলে দেখবেন ফুটনোট থাকে। আমি সেগুলো দেখে প্রাইমারি রেফারেন্স পড়ি। আমি উপর-উপর পড়াতে বিশ্বাসী নই। তবে নিজে যা করি সেটাকে জাহির করা পছন্দ করি না। মানুষ হিসেবে আমি পালটাইনি। নিজেকে স্বাবলম্বী, স্বাধীন দেখতে পছন্দ করি। অবসর সময়ে গিটার বাজাই। অন লাইনে পিয়ানো শিখি। বাচ্চাদের ডায়পার বদলাই। নিজের জামাকাপড়ও নিজে কাচি।”
এরপর সলমন গল্প শুরু করলেন তাঁর ছেলেবলা নিয়ে। যখন তাঁর আঠারো মাস বয়স, সেই সময়ই তাঁর বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। “আমি বাবাকে প্রায় ভাল করে দেখিনি বললেই চলে। এক বার আধবেলার জন্য দেখা হয়েছিল, যখন আমার চার বছর বয়স। আর এক বার আধবেলার জন্য দেখা হয় যখন আমার বয়স তেরো। বাবা ছিলেন ডাক্তার। বরিশাল থেকে ফিলাডেলফিয়াতে চলে গিয়েছিলেন। আমার মামারা থাকতেন নিউ অরলিয়ন্সে। মা আমাকে আর দিদিকে নিয়ে ওখানেই চলে যান। বাবা কোনও দিন আমাদের দেখাশোনার জন্য টাকা পাঠিয়েছে বলেও শুনিনি,” বলেন সলমন।
তাই ছোটবেলাতেই তাঁর মাকে সংসার সামলানোর জন্য নানা ধরনের কাজ করতে দেখেছেন। কখনও কোনও ‘কনভেনিয়েন্স স্টোর’-য়ের কাজ, তো কখনও কোনও হাসপাতালের ভেন্ডিং মেশিনে পয়সা সংগ্রহের দায়িত্ব। “মনে আছে ভেন্ডিং মেশিন খুলে গেলে একসঙ্গে কত কয়েন ঝনঝন করে পড়ত। যখন আমার পাঁচ বছর বয়স, মা আলাদা একটা বাড়ি নিয়ে থাকতে শুরু করলেন। আমার থেকে তিন বছরের বড় দিদি সারা। পড়াশোনায় ও বেশ ভাল ছিল। ওর কাছ থেকেই শিখলাম যে ভাল ইউনিভার্সিটিতে আমাদের মতো বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতে গেলে প্রথমেই চেষ্টা করতে হবে যাতে ‘গ্র্যান্ট’ পাওয়া যায়। দিদি ওভাবেই পড়াশোনা করেছে। আমিও সেই পথেই এগোই,” বলেন সলমন।
এমআইটিতে এসে কলকাতার এক বাঙালি বন্ধুর সঙ্গে থেকে বাংলা পড়তে শুরু করেন সলমন। “কলকাতা থেকে সোমক চট্টোপাধ্যায় বলে আমার এক বন্ধু ছিল এমআইটিতে। ও বাংলা পড়তে জানত। ওর সঙ্গে থেকে থেকে আমারও একটু বাংলা পড়ার চর্চা হয়। নিউ অরলিয়ন্স আর বাংলার মধ্যে বেশ একটা মিল আছে। গুমোট আবহাওয়া থেকে ঝাল মশলা দেওয়া খাবার অনেক কিছুতেই। ছোট থাকতে অনেক দিন পর্যন্ত বুঝতে পারতাম না হিন্দু , মুসলিম এ সবের পার্থক্য আসলে কী? ওদেশে আমরা দুর্গাপুজোর সময় প্যান্ডেলে যেতাম। বাঙালিদের মধ্যে যে হিন্দু, মুসলমান আলাদা হতে পারে এটা বুঝতে আমার বেশ কিছু বছর লেগে গিয়েছিল,” বলে চলেন সলমন।
অভিনেতা সলমন খানের সঙ্গে কখনও ‘ভ্রান্তিবিলাস’য়ের মতো ব্যাপারস্যাপার হয়নি? ঠাট্টা করে জানালেন, অনেকেই বলিউডি তারকার কথা জানতে চেয়ে ভুল করে তাঁর সাইটে ঢুকে পড়েন। “কিছু ক্ষেত্রে আবার আরও অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটে। যেমন ধরুন, আমেরিকার এয়ারপোর্ট। ৯/১১-র পর আমাকে শাহরুখ আর সলমনের নাম যেখানে আছে, সেই একই লিস্টে রাখা হয়েছিল। তো, একবার প্লেনে উঠতে যাচ্ছি, কিছু পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। তবে খান পদবিটার জন্য এখন আর আমেরিকায় কোনও ঝামেলা হয় না।”
আর সলমন খানের সিনেমা? দেখেন নাকি হিন্দি ছবি? “আমার বৌয়ের জন্ম পাকিস্তানে। ও ভাল হিন্দি বলে। সপ্তাহে অন্তত একটা হিন্দি সিনেমা দেখেই। ‘কাই পো চে’ আমাদের দু’জনেরই ভাল লেগেছে। ‘লেডিস ভার্সাস রিকি বহেল’ দেখেছি। হিন্দি সিনেমার ‘এসকেপিজম’ ব্যাপারটা বেশ ভাল লাগে আমার। সলমনের সিনেমা দেখেছি। বেশ পছন্দের। কী নাম যেন, যেখানে ও একজন র-এজেন্ট?” বুঝলাম বলছেন ‘এক থা টাইগার’য়ের কথা।
সলমনের ফিল্ম নিয়ে একটাই আফশোস ওঁর। এত কিছুর মধ্যে এখনও ‘দবাং’ দেখা হয়ে ওঠেনি যে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.