যখন চেয়ারে বসেছিলেন, কলকাতার গা থেকে তখনও ব্রিটিশের গন্ধ যায়নি। তখনও ইলেকট্রিক ট্রেন চোখে দেখেননি বাংলার মানুষ। চাঁদে তখনও মানুষের পা পড়েনি। এভারেস্টেও ওড়েনি বিজয় পতাকা।
তার পরে কালে কালে দুনিয়ায় নানা বিপ্লব ঘটে গিয়েছে। চাঁদ এবং এভারেস্ট বিজয় সম্পন্ন হয়েছে তো বটেই। দুনিয়া দাপিয়ে ‘মুনওয়াক’ সেরে ইহলোক ছেড়ে গিয়েছেন মাইকেল জ্যাকসনও! মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে মানব সভ্যতা। এঁটে উঠতে না-পেরে বিদায় নিয়েছে টেলিগ্রাম। তবু তাঁর পরিচয় পাল্টায়নি। ১৯৪৮-এও যা ছিলেন, ২০১৩-তেও তা-ই!
ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ! দল এবং বামফ্রন্টের গণ্ডি ছাড়িয়ে এ বার রেকর্ডের হাতছানি নবতিপর অশোকবাবুর সামনে! দেশ তো বটেই, সম্ভবত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও!
কোনও পদে কোনও রাজনীতিক সর্বাধিক কত বছর আছেন, তার নজির হিসাবেই বাম শরিক ফ ব-র রাজ্য সম্পাদক অশোকবাবুর নাম এখন বিবেচনায় এসেছে। তাঁর দলের ওই পদে অশোকবাবু আছেন ৬৫ বছর! এ দেশের কোনও রাজনীতিকেরই এমন রেকর্ড নেই। এমনকী, বহির্বিশ্বের ফিদেল কাস্ত্রো, চিয়াং কাই শেক বা মুয়াম্মার গদ্দাফিরাও তাঁর কাছে ম্লান! আপাতত অশোকবাবুর সম্পর্কে তথ্যপঞ্জি চেয়ে পাঠিয়েছেন একটি বেসরকারি ‘বুক অফ রেকর্ডস’ কর্তৃপক্ষ। সে সব হাতে পেলে ২০১৪ সালের রেকর্ড বইয়ে প্রবীণতম বাম নেতার উঠবে। |
কিস্সা কুর্সি কা |
অশোক ঘোষ
১৯৪৮ থেকে |
ফিদেল কাস্ত্রো
১৯৫৯-২০১১ |
চিয়াং কাই শেক
১৯২৬-১৯৭৫* |
মুয়াম্মার গদ্দাফি
১৯৬৯-২০১১ |
* তিন দফায় |
|
রেকর্ড বইয়ে অশোকবাবুর জায়গা পাকা করার উদ্যোগের নেপথ্যে রয়েছে ‘অশোক ঘোষ ফ্যান ক্লাব’। দলের কর্মী-সমর্থক এবং অশোকবাবুর কিছু অনুরাগী মিলে গড়া হয়েছিল ওই ফ্যান ক্লাব। ওই ক্লাবের তরফেই বুক অফ রেকর্ডস কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল, অশোকবাবু ফ ব-র রাজ্য সম্পাদক হিসাবে যত বছর আছেন, এমন নজির ভারতে কোথাও কারও নিশ্চয়ই নেই! আবেদনকারী রুদ্রজ্যোতি কর চৌধুরীর কাছে জবাব এসেছে অশোকবাবুর জীবনপঞ্জি সম্পর্কে তথ্য চেয়ে। ওই রেকর্ড বইয়ের তরফে এম কে জস লিখেছেন, ‘এটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা, সন্দেহ নেই’! তার পরেই কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হয়েছে ফ ব দফতরে।
রেকর্ড বইয়ে সাধারণত রাজতন্ত্রের থেকে অন্যদের আলাদা করে উল্লেখ করা হয়। বংশগত সূত্রে কে কত দিন রাজা বা রানি ছিলেন, তার সঙ্গে রাজনীতিকদের রেকর্ড তুলনা করা হয় না। বুক অফ রেকর্ডস সূত্রেই জানা যাচ্ছে, মহারাষ্ট্রের এক পঞ্চায়েত প্রধান ৩৫ বছর ওই পদে আসীন! ‘লঙ্গেস্ট সার্ভিং পলিটিসিয়ান’ হিসাবে এই রেকর্ড অশোকবাবু বহু বছর আগেই টপকে বসে আছেন! দেশের বাইরে তাকালে তাঁর কাছাকাছি বলতে ফিদেল কাস্ত্রো। ২০১১ সালে ইনিংস শেষ করার সময় যিনি কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট হিসাবে ৫২ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেছেন। চিয়াং কাই শেক ৪৬ বছর, গদ্দাফি ৪২ বছর। তা-ও কাই শেক আবার একাদিক্রমে নয়। চিন এবং তাইওয়ান মিলে তাঁর ইনিংসে অন্তত তিন বার ছেদ পড়েছে। এমনকী, উত্তর কোরিয়ার কিংবদন্তি প্রেসিডেন্ট কিম ইল সুং (যাঁকে চিরন্তন বা ইটারনাল প্রেসিডেন্টের তকমা দেওয়া হয়েছিল) থেমে গিয়েছেন ৪৫ বছরে।
সচরাচর একনায়কতন্ত্র বা একদলীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্র এবং শাসক দলের প্রধান যাঁরা হয়েছেন, তাঁদেরই ঝুলিতে রয়েছে বছরের পর বছর গদিতে থাকার কৃতিত্ব। অশোকবাবুর কৃতিত্ব আরও অনন্য এই কারণেই যে, তিনি কখনও সরকারি ক্ষমতায় বসেননি। মহাকরণ বা বিধানসভায় পা-ও ফেলেননি! শুধু রাজনৈতিক পদে একটানা এত বছর কোথাও এমন নজির কখনও আছে কি না, জোরদার তল্লাশি চলছে এখন!
রেকর্ড বুক কর্তৃপক্ষ জানতে চেয়েছেন, কত দফায় অশোকবাবু ওই পদে থেকেছেন। এর জবাবে ফ ব-র নথি ঘেঁটে জানা যাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত ১৫ বার তিনি রাজ্য সম্পাদক হয়েছেন! সাতের দশকে জরুরি অবস্থার সময় বছরদশেক সম্মেলন হয়নি। কিন্তু তিনিই ছিলেন সম্পাদক। ওই পদে যাওয়ার আগে ১৯৪২-৪৩ সালে জেলও খেটেছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেখলে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য জন ডিনজেল এ বছরেই ৩০ বারের জন্য সদস্য হয়েছেন! কিন্তু বছরের হিসাবে তিনিও অশোকবাবুর চেয়ে পিছিয়ে! ডিনজেল আমেরিকার কংগ্রেসে আছেন ১৯৫৫ থেকে। “আমরা তো জানি। কিন্তু এই বিরল নজিরের কথা সকলে যাতে জানতে পারেন, তার জন্যই রেকর্ড বইয়ে এই তথ্যটা ওঠা দরকার।” বলছেন ‘অশোক ঘোষ ফ্যান ক্লাবে’র তরফে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং জানাচ্ছেন এর সঙ্গে দল হিসাবে ফ ব-র কোনও সম্পর্ক নেই।
স্বয়ং অশোকবাবু অবশ্য এ সবের কিছুই জানতেন না। পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি-বৈঠক সেরে চেন্নাই থেকে ফিরে দেখেন, তাঁর বায়োডাটা খোঁজা হচ্ছে রেকর্ড বুকের জন্য! “ছেলেরাই এ সব করেছে। আমার একটাই ভাল হল। কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে কিছু পুরনো জিনিস আবার জানা গেল!” অনাবিল হাসছেন নব্বইয়ের ‘নবীন’! |