পুস্তক পরিচয় ১...
মর্যাদা পেলেন উস্তাদ মনসুর
ওয়ান্ডার্স অব নেচার/ উস্তাদ মনসুর অ্যাট দ্য মুঘল কোর্ট, অশোককুমার দাস। মার্গ ফাউন্ডেশন, ২৮০০.০০
ভারত মহাসাগরে মরিশাসের মতো প্রত্যন্ত দ্বীপেই শুধু দেখা যেত ডোডো পাখি। ষোড়শ শতকের শেষ থেকেই ডোডো-র কথা জানা গেলেও এর প্রথম বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় ১৬৩১-এ, এক অনামা ডাচ নাবিকের লেখায়। এর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই চিরতরে হারিয়ে গেল ডোডো। অনেক বর্ণনা থাকলেও ডোডো-র নিখুঁত এবং রঙিন ছবি খুব কমই পাওয়া গিয়েছে। ১৯৫৫-য় সেন্ট পিটার্সবার্গে (তখন লেনিনগ্রাদ) মুঘল চিত্রকলার এক অ্যালবামে এমনই একটি ছবি গবেষকদের নজরে পড়ে। আরও চার রকম পাখির সঙ্গে মধ্যমণি ডোডো। এর এত চমৎকার, বিজ্ঞানসম্মত ভাবে অবিকল প্রতিকৃতি আর দ্বিতীয়টি নেই। নিঃসন্দেহে সামনে থেকে দেখেই আঁকা হয়েছিল ছবিটি। কিন্তু ভারতে ডোডো এল কোথা থেকে?
ব্রিটিশ পর্যটক পিটার মান্ডি সুরাটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফ্যাক্টরি চত্বরে কয়েকটি ডোডো দেখেছিলেন বলে তাঁর জার্নালে উল্লেখ আছে। মান্ডি ১৬২৮-’৩৪ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করেন, কাজেই অনুমান করা যায় তাঁর দেখা ডোডো ইংরেজ বণিকরাই মরিশাস থেকে এনেছিলেন। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের (মৃত্যু ১৬২৭) দুর্লভ পাখি আর জীবজন্তুর প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল, তাই ইংরেজরা তাঁকে একটি ডোডো উপহার দিয়ে থাকতে পারে।
১৬২৩-’২৪-এর পর জাহাঙ্গির আর তাঁর স্মৃতিকথা লিখতে পারেননি, তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি-তে হয়ত সে কারণেই ডোডো-র কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু এমন উপহার পেয়ে থাকলে জাহাঙ্গির নিশ্চয়ই তাঁর সেরা প্রকৃতিচিত্রী উস্তাদ মনসুরকে বলেছিলেন ডোডো-র ছবি এঁকে রাখতে। সেন্ট পিটার্সবার্গ অ্যালবামের স্বাক্ষরবিহীন ডোডো সেই উস্তাদ মনসুরেরই কীর্তি বলে অনুমান করা হয়, জাহাঙ্গির যাঁকে মুঘল ভারতে কোনও শিল্পীর সেরা শিরোপা ‘নাদির-উল-আসর’ বা ‘যুগের বিস্ময়’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
ডোডো, সেন্ট পিটার্সবার্গ অ্যালবাম। শিল্পী: উস্তাদ মনসুর
উস্তাদ মনসুরের ছবির সঙ্গে প্রায় অর্ধশতাব্দী কাটিয়েছেন অশোককুমার দাস, সারা পৃথিবী ঘুরে ছোটবড় অজস্র সংগ্রহশালা আর ব্যক্তিগত সংগ্রহে এই মুঘল শিল্পীর আঁকা ছবি আর অলংকরণ খুঁটিয়ে দেখেছেন, তাঁকে নিয়ে লিখেছেনও অনেক। এত দিনে লিখলেন মনসুরকে নিয়ে আস্ত একখানা বই— প্রকৃতির নানা খুঁটিনাটি চিত্রণে আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী এই শিল্পীর যোগ্য সম্মান নিঃসন্দেহে।
আকবরের তসবিরখানায় কাজ শুরু মনসুরের, কোনও বিখ্যাত শিল্পীর উত্তরাধিকার ছিল না তাঁর। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করতে করতেই নিজেকে প্রমাণ করা। ঐতিহাসিক ছবি আর দরবার-দৃশ্যের চিত্রণে বাসবন, কান্হা, মিসকিন, নানহা-র মতো বিখ্যাত চিত্রীদের সহায়তা ছাড়া পাণ্ডুলিপি অলংকরণও ছিল তাঁর কাজ। অলংকরণশিল্পী হিসেবে নিজের ভূমিকা কখনও ভোলেননি মনসুর— ‘যুগের বিস্ময়’ হওয়ার পরেও স্বাক্ষর করেছেন ‘মনসুর নক্কাশ’ বলে। বস্তুত অক্সফোর্ডের বডলিয়ান গ্রন্থাগারে রক্ষিত জামি-র বাহারিস্তান, ব্রিটিশ লাইব্রেরি-র আকবরনামা ও তেহরান-এর গুলশন অ্যালবামে মনসুরের স্বাক্ষরিত অলংকরণের যা নমুনা অশোককুমার দাস এ বইয়ে দেখিয়েছেন, তা ভারতীয় গ্রন্থনির্মাণের ইতিহাসে খুবই উল্লেখযোগ্য।
আকবরের তসবিরখানায় কিছুটা স্বীকৃতি পাওয়ার পর কানহা-র সঙ্গে বাবরনামা-র পাণ্ডুলিপিতে নীলগাই কি বুনো মোষের ছবি আঁকার সঙ্গে ঐতিহাসিক বিষয়-চিত্রণও চলছিল। ১৬০০-১৬০৪ বিদ্রোহী জাহাঙ্গিরের সঙ্গে ইলাহাবাদে ছিলেন মনসুর। ১৬০৫-এ তখতে বসার পর অন্য নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের প্রতিকৃতি ইত্যাদি আঁকার দায়িত্ব দেন জাহাঙ্গির, আর মনসুরকে উৎসাহ দিলেন প্রকৃতি-চিত্রণে। মনসুর হলেন জাহাঙ্গিরের ছায়াসঙ্গী, দরবারে কি সফরে যেখানেই প্রকৃতির কোনও কিছু, ফুল, পাখি কি জীবজন্তু সম্রাটের কাছে বিস্ময়কর লাগত, মনসুর তা-ই যথাযথ ভাবে ধরে রাখতেন রঙ-তুলিতে।
টার্কি, ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম। শিল্পী: উস্তাদ মনসুর
কত ছবি এঁকেছিলেন মনসুর তার হিসেব নেই। শুধু কাশ্মীরেই নাকি তিনি শতাধিক ফুলের ছবি আঁকেন, লিখেছেন জাহাঙ্গির। সব ছবিতে স্বাক্ষরও থাকত না, তা ছাড়া বহু মূল মুঘল সচিত্র পাণ্ডুলিপি বা ছবির অ্যালবাম পরে টুকরো টুকরো করে বিক্রি হয়ে যাওয়ায়, নতুন করে বাঁধিয়ে ফেলায় ফ্রেমের মধ্যে বা অলংকরণের অলক্ষে থাকা স্বাক্ষর হারিয়ে গিয়েছে। তবু অশোককুমার দাসের মতো বিশেষজ্ঞরা শৈলীবিচার করে অনেক ছবির শিল্পী চিহ্নিত করেছেন, ইতিহাসের সাক্ষ্যপ্রমাণও কাজে লাগিয়েছেন, যেমন ডোডো-র ছবিটি। এমনই আর একটি ঘটনা ঘটে ১৬২১-এ। সুরাট ও ক্যাম্বে-র গভর্নর মির জাফর জাহাঙ্গিরকে একটি আবিসিনীয় জেব্রা উপহার দেন। জেব্রা দেখে প্রথমে জাহাঙ্গিরের সন্দেহ হয়েছিল, রঙ করা কি না। পরে যখন তিনি নিশ্চিত হলেন এ প্রাণী ঈশ্বরেরই সৃষ্টি, তখন পারস্যের শাহ আব্বাসকে তা উপহার পাঠালেন, আর তার আগে মনসুরকে বললেন তার ছবি এঁকে রাখতে। লন্ডনে ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে (ভি অ্যান্ড এ) রক্ষিত মিন্টো অ্যালবামের এই জেব্রার ছবিতে জাহাঙ্গিরের নিজের হাতে লেখা আছে ‘নাদির-উল-আসর উস্তাদ মনসুর’-এর নাম। আবার ১৬১২-য় এ ভাবেই এক টার্কি মোরগ পৌঁছয় সম্রাটের দরবারে। খুব সম্ভব পর্তুগিজ মিশনারি ও বণিকদের মাধ্যমেই প্রথম গোয়ায় আসে টার্কি। স্মৃতিকথায় জেব্রার মতো টার্কির কথাও লিখেছেন জাহাঙ্গির। মনসুরের স্বাক্ষরিত টার্কির ছবিটি আছে ভি অ্যান্ড এ-তে।
দুঃখের বিষয়, জাহাঙ্গিরের স্মৃতিকথা, আর কিছু ছবিতে সম্রাটের নিজের হাতে লেখা শিল্পীর নাম ছাড়া মনসুর সম্পর্কে সমসাময়িক সূত্রে আর কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। সুরাত থেকে আসা ডোডো-র ছবিটি যদি মনসুরের আঁকা হয়, তা হলে সেটাই তাঁর এ পর্যন্ত পাওয়া শেষ ছবি (আনু. ১৬২৭)। এর পর শাহজাহানি চিত্রশালায় মনসুরের কোনও হদিশ মেলেনি। মনসুর সম্পর্কে সব তথ্য, বিতর্ক, বিশ্লেষণের সঙ্গে অজস্র সুমুদ্রিত ছবি তুলে ধরে অশোককুমার দাস মুঘল চিত্রকলার এক বিশেষ ঘরানাকে আলোকিত করলেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.