ডাকঘর

ভুল বোঝাবুঝি হবে
সুবে বাংলার রাজধানী সংস্কারে খরচ ১৫ কোটি’ শীর্ষক খবরে মীর জাফরের বাসভবনকে নিমকহারাম দেউড়ি বলা হয়েছে। ফলে মানুষের মনে ভ্রান্ত ধারণা জন্ম নেবে ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনের গভীরে আঘাত হানবে। মসনদে বসার পূর্বে মীর জাফর যে বাড়িতে বাস করতেন তা অনেক আগে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তার একাংশের একটি গেট শুধু রয়েছে। কিন্তু গেটকে তো দেউড়ি বলা যায় না। মসনদে বসার পূর্বে তিনি কোনও দেউড়িতে বাস করতেন না। তিনি জাফরাগঞ্জে নবাব আলিবর্দি খানের নির্মিত প্রাসাদে বাস করতেন। নবাব আলিবর্দি তাঁর বোন শাহাখানামকে ওই ভবন যৌতুক দেন। শাহাখানাম মীর জাফরের প্রধান পত্নী ছিলেন। পরবর্তী কালে শাহাখানামের প্রোপৌত্র আজাম আলি খান বাহাদুর বসবাসের জন্য আরও একটি প্রাসাদ তৈরি করেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য তার সংলগ্ন একটি ইমামবাড়া তৈরি করেন। ওই ইমামবাড়ায় হজরত ইমাম হোসেনের পবিত্র কবরের জরি ছিল যা আজাম আলি খান বাহাদুর কারবালা থেকে নিয়ে এসে এখানে স্থাপন করেছিলেন। ওই জরিটি খুবই পবিত্র ও জাগ্রত। বর্তমানে যে গেটটিকে নিমকহারাম দেউড়ি আখ্যা দেওয়া হয়েছে সেটিই একমাত্র প্রবেশপথ ওই ইমামবাড়াটির। ছুঁড়ে দেওয়া ‘নিমকহারাম’ শব্দটি সকল সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বিশ্বাসে আঘাত হেনেছে। পলাশির যুদ্ধে মির জাফর বিরত থাকায় আপনারা তাঁকে নিমকহারাম তকমা দিয়ে থাকেন। কিন্তু জগত্‌ শেঠ, রায় দুর্লভ, উমি চাঁদ, রানি ভবানী, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মতো ষড়যন্ত্রকারীরা পর্দার আড়ালেই রয়ে গিয়েছেন। Dr. Tarachand Freedom movement in India গ্রন্থে লিখেছেন, “সিরাজদৌলার পতন নিশ্চিত হয়েছিল। কারণ জগত্‌ শেঠ তাঁর বিপক্ষে ছিলেন।” তা ছাড়া তখনও ভারতে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় চেতনার জন্ম হয়নি। ফলে সিরাজ সামগ্রিক ভাবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ইংরেজ বিরোধী যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন ও যাঁরা সহযোগিতা করেননি তাঁরা দেশদ্রোহী, বা বিশ্বাসঘাতক, এ কথা যুক্তিযুক্ত নয়। Dr. R.C. Majumdar তাঁর An Advanced History of India গ্রন্থে লিখেছেন, “জাতীয় ভাবধারার অবর্তমানে আপনারা শুধুই মিরজাফরকে বিশ্বাসঘাতক বলে দোষারোপ করেছেন।”
ঐতিহাসিক সত্য
গত ২৭ জুলাই প্রকাশিত ‘নিমকহারাম দেউড়ি’ শীর্ষক হুসনা জা-র পত্রে ইতিহাসের বেশ কিছু বিকৃতি ঘটেছে। কেবল সরকারি নথিই নয়, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরীও তাঁর লেখা ‘নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ’ গ্রন্থের ১৪৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “জাফরাগঞ্জের যে ভবনে সিরাজের হত্যাকাণ্ড (মির জাফরের পুত্র মীরনের ইশারায় মহম্মদি বেগের হাতে ২ জুলাই ১৭৫৭) হয়, তাকে মুর্শিদাবাদবাসীরা ‘নেমকহারমের দেউড়ি’ আখ্যা দিয়েছে।” সমকালীন কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ এবং ব্রিটিশ কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটসের বক্তব্য ও ঐতিহাসিক দস্তাবেজ থেকে জানা যায়, সিরাজ তরুণ বয়সে ‘অত্যাচারী ও বেপরোয়া’ হলেও পনের মাসের রাজত্বে (১০ এপ্রিল ১৭৫৬ থেকে জুন ১৭৫৭) ‘কোনও পাগলামি, অর্বাচীনতা ও নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দেননি’, ‘দেশের শাসক হিসাবে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেছেন’। সিরাজের ক্ষমতা লাভের পর ব্রিটিশ কোম্পানি দস্তকের অপব্যবহার, দুর্গ সংস্কার, নবাবের আইনভঙ্গকারী কর্মীদের আশ্রয় দান ওই সব বিষয় নবাব ও কোম্পানির মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে। ঐতিহাসিক পিটার মার্শল ও রজতকান্ত রায়ের মতে ঘসেটি বেগম, জগত্‌ শেঠরা (মহাতাব রায় ও মহারাজা স্বরূপ চাঁদ), রায় দুর্লভ প্রমুখ মুর্শিদাবাদের অভিজাতবর্গ সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রন্ত গড়ে তোলেন। ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরীর মতে, ওই চক্রান্তের হোতা ছিলেন উইলিয়াম ওয়াটস ও রর্বাট ক্লাইভ প্রমুখ ব্রিটিশ কোম্পানির কর্মচারীরা। মির জাফরের সঙ্গে ব্রিটিশ কোম্পানির চুক্তি হয় ১৭৫৭ সালের ৫ জুন। তার আগে ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে নবাবের ‘আলিনগর চুক্তি’ হয়। আলিনগরের চুক্তি ভঙ্গের মিথ্যা অজুহাতে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সমকালীন লেখক গোলাম হোসেনের লেখা ‘সিয়র’ গ্রন্থের ২৩১ পৃষ্ঠায় রয়েছে, ‘মির জাফর তাঁর অধীনস্ত সৈনবাহিনী নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন, ... নিতান্ত মজা দেখতেই যেন যুদ্ধে আসা।” তার ফল হিসাবে অধ্যাপক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পলাশি থেকে পার্টিশন’ গ্রন্থে লেখেন, “ইংরেজদের হাতের পুতুল হয়ে মী র জাফর নতুন নবাব হিসাবে বাংলার মসনদে বসেন।” এই সেই মির জাফর যিনি কোম্পানির অর্থের দাবি না মেটাতে পারায় ও ওলন্দাজদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখায় ১৭৬০ সালে ক্ষমতা হারান। তা সত্ত্বেও তিনি নির্লজ্জের মতো ১৭৬৩ সালে ফের মসনদে বসেন। দুর্বল নবাবির কারণে তিনিই উত্তরাধিকারীদের জন্যও রেখে যান প্রশাসনিক অক্ষমতা ও ব্রিটিশ ভাতার উপর নির্ভরশীলতা। সৈয়দা হুসনা জা ক্লাইভের জীবনী গ্রন্থের উল্লেখ করে বোঝাতে চেয়েছেন, ক্লাইভ যেন মুর্শিদাবাদবাসীর ত্রাতা। বাস্তবে ক্লাইভই বাংলার স্বাধীনতা কেড়ে নেন, শুরু হয় ‘পলাশি লুণ্ঠন’, ১৭৬০ সালে বিদেশি কোম্পানি দখল করে বাংলার দেওয়ানি, ১৯৬৫-৭২ পর্যন্ত চলে দ্বৈত শাসন। মির জাফর একা চক্রান্তকারী না হলেও পলাশির যুদ্ধে নবাবের সেনা প্রধান হিসাবে তিনি বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন। এ কারণেই তাঁর নামটা ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র সমার্থক হয়ে উঠেছে। এটা লজ্জার হলেও কখনই ‘অবোধ ইতিহাস বিকৃতকারীদের মুখের ভাষা নয়’। বরং যুক্তিগ্রাহ্য ও ঐতিহাসিক সত্য।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.