পূর্ব কলকাতা: লেকটাউন, বারাসত
বিপন্ন শৈশব
আতঙ্কের পাঠ
ছাদের চাঙড় খসে পড়ছে। ঘরের দেওয়ালে গজিয়ে উঠেছে আগাছা। দেওয়ালগুলিতে ফাটল ধরে ধরে অত্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় পৌঁছেছে। ঘরের চারপাশে ঝোপে-ঝাড়ে বিষাক্ত সাপের আনাগোনা। এই ছবি পুরনো শ্রেণিকক্ষের। ২০-২৫ বছর ধরে পড়ে থেকে ওই শ্রেণিকক্ষ দু’টির অবস্থা এ রকমই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ঘরের তিন দিকে কয়েকটি পিলার উপরের ঢালাই সমেত বিপজ্জনক ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই শ্রেণিকক্ষ দু’টিকে ঘিরে শিখরপুর নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলে তৈরি হয়েছে রীতিমতো আতঙ্কের পরিবেশ।
অভিযোগ, পঞ্চাশের দশকে তৈরি এই পরিত্যক্ত শ্রেণিকক্ষ ভেঙে ফেলার অনুমতি মিলছে না। লিখিত অনুমতি চেয়েও ফল হয়নি। খেলাধুলো করতে করতে বিপজ্জনক ঘরটিতে মাঝেমধ্যেই ঢুকে পড়ছে স্কুলের কচিকাঁচারা। যে কোনও সময়ে চাল ভেঙে বিপদ ঘটতে পারে এই আশঙ্কায় আতঙ্কিত শিক্ষক-শিক্ষিকারা। চেষ্টা করেও পড়ুয়াদের আটকানো যাচ্ছে না। তাঁদের অভিযোগ, রাজারহাটের বিডিও-কে জানিয়েও অনুমতি মেলেনি। এমনকী, রাজারহাট ব্লকের চাঁদপুর পঞ্চায়েত ওই ঘর ভাঙার টেন্ডার ডাকলেও তাতে কোনও ফল হয়নি।
শিখরপুর নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলটি অনুমোদন পায় ১৯৪২ সালে। অনুমোদনের পরে প্রথমে খড়ের চাল দেওয়া স্কুলঘর তৈরি হয়। পরে কয়েক বছরের মধ্যে তৈরি হয় প্রায় ৩০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট চওড়া একটি শ্রেণিকক্ষ। দু’টি দরজা ও চারটি জানলা বিশিষ্ট ওই একটি কক্ষেই চলত নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলটি। ক্রমে পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়লে এবং ওই পাকা শ্রেণিকক্ষ জরাজীর্ণ হয়ে পড়লে স্কুলের নিজস্ব জমিরই অন্য প্রান্তে তৈরি হয় নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলের দ্বিতল ভবন। এর পর থেকে পুরনো শ্রেণিকক্ষটি পরিত্যক্ত হয়েই থেকে যায়।
২০১০ সালে নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলের নতুন বিল্ডিংয়েই চালু হয় শিখরপুর জুনিয়র হাইস্কুল। শিখরপুর নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলের পড়ুয়ার সংখ্যা ২০ এবং জুনিয়র হাইস্কুলের পড়ুয়া ৩৯ জন। দুই স্কুল মিলিয়ে গড়ে জনা ৫০ কচিকাঁচার নিত্য যাতায়াত। পরিত্যক্ত শ্রেণিকক্ষেরই এক পাশে আলাদা ভাবে তৈরি একটি ঘরে এক সঙ্গে দুই স্কুলের মিড ডে মিল খাওয়া চলে। খাওয়ার পরে মাঝেমধ্যেই খুদে পড়ুয়ারা লুকোচুরি বা অন্য কোনও খেলা খেলতে ঢুকে পড়ে পুরনো ওই শ্রেণিকক্ষে। আতঙ্কিত অভিভাবকেরা জানালেন, ওই ঘরে বিষাক্ত পোকামাকড় ছাড়াও ঘরটি ভেঙে প্রাণহানির আশঙ্কাও আছে।
বছর দুই আগে নিম্ন বুনিয়াদির বিদ্যালয় শিক্ষা কমিটি, জুনিয়র হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটি এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা পুরনো ওই ঘরটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। সেই মতো বিষয়টি রাজারহাট সার্কলের স্কুল ইনস্পেক্টরকে জানালে তিনি গত বছর জুনে ঘরটি ভাঙার জন্য টেন্ডারও ডাকেন। কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি কোনও ঠিকাদারের। ফলে ভাঙা হয়নি বিপজ্জনক ঘরটি।
এর পরে জুনিয়র হাইস্কুলের পক্ষ থেকেও ঘরটি ভাঙার অনুমতি চেয়ে চিঠি দেওয়া হয় রাজারহাট সার্কলের এস আই ফিদিয়া জয়নাব এবং রাজারহাটের বিডিও অমলেন্দু সমাদ্দারকে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁদের পক্ষ থেকে কোনও অনুমতি মেলেনি বলে স্কুল সূত্রে খবর। অভিভাবকদের অভিযোগ, খুদে পড়ুয়াদের জন্য বড় বিপদ রয়েই গেল।
শিখরপুর নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা দেবাঞ্জনা চৌধুরী বলেন, “বিপজ্জনক বাড়িটির কাছাকাছি মিড ডে মিল খাওয়ার জায়গা। খাওয়ার পরে কিছু ক্ষণ খেলাধুলো করে বাচ্চারা। নজর এড়িয়ে কোনও বাচ্চা যদি ওই ঘরে ঢোকে আর কোনও বিপদ ঘটে যায়, এই আতঙ্কে থাকি আমরা। বাচ্চাদের ওই ঘরে ঢুকতে নিষেধ করা হলেও ওরা শোনে না।”
শিখরপুর জুনিয়র হাইস্কুলের টিচার ইন-চার্জ রণজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, “পুরনো ঘরটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। পড়ুয়াদের নিরাপত্তার স্বার্থে দ্রুত ওটা ভেঙে ফেলা উচিত। ওখানে জুনিয়র হাইস্কুলের নতুন বিল্ডিং এবং মিড ডে মিলের ঘর তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। টাকাও এসেছে। টেন্ডার ডাকা হয়েছিল ঘর ভাঙার জন্য। কিন্তু ফল হয়নি। এ বার আমরাই লোক ধরে ভেঙে ফেলতে অনুমতি চেয়েছি।” এ ব্যাপারে রাজাহাটের বিডিও অমলেন্দু সমাদ্দার বলেন, “শীঘ্রই ইঞ্জিনিয়ার পাঠাবো। আমিও পরিদর্শন করব। ঘরটি কতটা ভয়াবহ তা দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে বাঁশ দিয়ে জায়গাটি ঘিরে দেওয়া হবে।” পাশাপাশি, শিখরপুর জুনিয়র হাইস্কুলের অস্থায়ী পরিচালন সমিতির সম্পাদক তথা প্রাইমারি স্কুলের রাজারহাট সার্কলের এসআই ফিদিয়া জয়নাব বলছেন, “নতুন পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচন হয়েছে। জুনিয়র হাইস্কুলের অস্থায়ী পরিচালন সমিতি এবং প্রাইমারি স্কুলের ভিলেজ এডুকেশন কমিটিতে পঞ্চায়েত সমিতির প্রতিনিধিত্ব থাকে। ফলে পঞ্চায়েত সমিতির বোর্ড গঠন না হলে এই কমিটিগুলিও গঠন করা যাবে না। পঞ্চায়েত সমিতির বোর্ড গঠন হলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” রাজারহাটের তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত বললেন, “আমার কাছে অভিযোগ এলে কী করা যায় দেখব। প্রয়োজনে বিডিও-কেও বলব।”

ছবি: সুদীপ ঘোষ




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.