ব্যাগ গুছিয়ে...
পূর্ণ পুনাখা
পাশের বাড়িকে আবার কেউ বিদেশ বলে নাকি! ভুটান যাওয়ার আগে এটা ভেবেই বেশ মজা লাগছিল। যদিও বিমান ছাড়বে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে, কিন্তু যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট লাগবে না। যদিও ভুটানের নিজস্ব মুদ্রা রয়েছে, কিন্তু সেখানকার মানুষ ভারতীয় টাকাই নিতে বেশি পছন্দ করেন!
এ হেন ‘বিদেশ সফর’ তাই পাশের বাড়ি যাওয়ার মতোই রোমাঞ্চহীন। বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ অবশ্যই থাকে, কিন্তু একেবারে অপরিচিত পরিবেশে গিয়ে পড়ার উত্তেজনাটা থাকে না।
ভুটানে সপ্তাহখানেক কাটিয়ে অবশ্য মনে হল, চারপাশের চেনা পরিবেশ থেকে এ যেন অনেকটাই আলাদা। পারো বিমানবন্দরে নামার পরমুহূর্ত থেকে যে স্নিগ্ধতা মন ছুঁয়ে নিয়েছিল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার রেশ কাটেনি। গতি আছে, কিন্তু অস্থিরতা নেই ভুটানে। রাস্তায় পর পর গাড়ি, কিন্তু হর্নের শব্দ শোনা যায় না বললেই চলে। সব সময়ে সকলের মুখে হাসি। দিনভর সে দেশের ছেলেমেয়েরা ট্র্যাডিশন্যাল পোশাক পরে অফিসের কাজ সামলায়, কিন্তু সন্ধ্যার পরে তাদের নিজস্ব জগৎ। জিন্স, টি-শার্ট, স্কার্ট সবই চলে তখন। ফাঁকা সুনসান রাস্তায় নিরাপদে অল্পবয়সী মেয়েরা রাত ১১টার পরেও দাঁড়িয়ে গল্প করছে, রাত ১০টায় বিয়ার পাবে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মত্ত, কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না। কেউ অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে না। এমন অভিজ্ঞতা এখন তো ‘বিরল’-এর তালিকাতেই ঠাঁই পাচ্ছে।
পারো আর থিম্ফুর পাশাপাশি পুনাখা! এই তিনটি জায়গা ঘিরেই ছিল আমাদের বেড়ানোর পরিকল্পনা। বেড়ানো শেষ হতে মনে হয়েছিল, সময়টা শুধু পুনাখায় কাটালেও ক্ষতি ছিল না।
ভুটানের যেখানেই যাওয়া হোক না কেন, মুখ্য আকর্ষণ হল জং। দুর্গের আদলে তৈরি এক ধরনের স্থাপত্য, যেখানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা থাকেন। কোথাও কোথাও আবার এই জং থেকেই চালানো হয় কিছু প্রশাসনিক কাজকর্মও। যে কোনও জং-এর প্রবেশপথটা হয় তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। কাঠ আর লোহার তৈরি বিশাল দরজা। বিশাল উঠোন, বড় বড় ঘর, সর্বত্রই উজ্জ্বল রং আর বৌদ্ধ মোটিফে ভরা। এক একটি জং যেন ইতিহাসের এক একটা অধ্যায়।
থিম্ফুতে একের পরে এক জং ঘুরে দেখার পাশাপাশি সময় কেটেছে সেখানকার ন্যাশনাল লাইব্রেরি, টেক্সটাইল মিউজিয়াম আর ছোট্ট চিড়িয়াখানায়। একমাত্র ওই চিড়িয়াখানাতেই দেখা মিলবে ভুটানের জাতীয় পশু টাকিন-এর। থিম্ফুর আর এক আকর্ষণ দোর্দেনমা বুদ্ধমূর্তি। ১৬৯ ফুট উঁচু এই মূর্তি বিশ্বের উঁচু বুদ্ধমূর্তিগুলির অন্যতম।
পারো থেকে দেড় ঘণ্টা গাড়িতে গেলে চেলে লা পাস। ৩৯৮৮ মিটার উঁচু। ভুটানের মানুষের কাছে এটা খুব পবিত্র জায়গা। আমরা যখন চেলে লা-য় পৌঁছলাম তখন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। ঠান্ডায় জমে যাওয়ার অবস্থা। দূরে আবছা পাহাড়ের রেখা। চার দিকে রং-বেরঙের অজস্র বাহারি ফুল। কিন্তু মন ভরে দেখব, সে উপায় কই? স্রেফ একটা ছাউনি রয়েছে চেলে লা পাস-এ। গাড়ি থেকে নেমে বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে সেখানেই গাদাগাদি করে দাঁড়ালাম অনেকে মিলে। এক কাপ চায়ের জন্য মনটা ছটফট করছিল। গাড়ির চালক বললেন, কিচ্ছু নেই।
পারো ভ্যালির ৯০০ মিটার উপরে রয়েছে বৌদ্ধ মন্দির টাইগার্স নেস্ট। স্থানীয় বিশ্বাস, গুরু রিন পোচে এক বাঘিনির পিঠে চড়ে এখানে পৌঁছেছিলেন। তার পরে এখানেই সাধনায় বসেন। তখন থেকেই এই জায়গার নাম ‘টাইগার্স নেস্ট’। বৌদ্ধদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র জায়গা। ১৯৯০-এ আগুন লেগে বড়সড় ক্ষতি হয়েছিল এর। পরে তা সারিয়ে নেওয়া হয়।
থিম্ফু, পারোর পরে এ বারে আমাদের মূল আকর্ষণ পুনাখা। পুনাখা এক সময়ে ভুটানের রাজধানী ছিল। ১৯৫৫-য় তা থিম্ফুতে স্থানান্তরিত হয়। এখন পুনাখাকে বলা হয় ভুটানের শীতের রাজধানী। থিম্ফু থেকে গাড়িতে ঘণ্টা তিনেকের দূরত্ব।
দুই নদী। মো চু আর পো চু! পাহাড়ের কোল ধরে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে বহু দূর। মো চু নারী আর পো চু পুরুষ। এমনই বিশ্বাস সেখানকার মানুষের। স্থানীয় ভাষায় চু শব্দের অর্থ নদী। পো চু আর মো চু এসে মিলেছে পুনাখায়। একেবারে ছবির মতো একটা উপত্যকা। যে দিকে চোখ যায় যেন ঘন সবুজের গালিচা পাতা। সারা বছরই নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া পুনাখায়। পর্যটকদের ভিড় তাই সব সময়েই লেগে থাকে।
পুনাখার জং ঐতিহাসিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দু’দুটো ভয়াবহ আগুন এবং ভূমিকম্পে এই জং সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ভুটানের বর্তমান রাজার আমলেই এটা নতুন ভাবে নির্মাণ করা হয়। গ্রীষ্মে যখন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা থিম্ফুতে চলে যান, তখন এই জং পর্যটকদের জন্য খোলা হয়। আমরা গিয়েছিলাম মে মাসের শেষের দিকে। তাই ঘুরে দেখার সুযোগটা ছিল। রাজকীয় বলতে ঠিক যা বোঝায়, পুনাখা জং একেবারে তাই। পো চু আর মো চু-র মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই স্থাপত্য। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে একটা কাঠের সেতু দিয়ে একে যোগ করা রয়েছে। শীতের সময়ে সন্ন্যাসীরা এখানে এসে থাকেন। পুনাখার এই জংয়েই রাজার বিয়ে হয়েছিল ২০১১-য়। পর্যটকরা সে নিয়ে প্রশ্ন করলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা হাসিমুখে ঘুরিয়ে দেখান বিয়ের সেই জায়গা।
পুনাখাতেই রয়েছে ‘ফার্টিলিটি টেম্পল’। ১৪৯৯-এ তৈরি। নাম থেকেই বোঝা যায়, এই মন্দির সম্পর্কে স্থানীয় বিশ্বাস ঠিক কী। রয়েছে ছোট ছোট মন্দিরের মতো বৌদ্ধ ‘চোর্তেন’, যা কিনা অশুভ শক্তিকে হঠিয়ে শুভ শক্তিকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে বলে বৌদ্ধদের বিশ্বাস।
পুনাখার একটা বড় আকর্ষণ এখন হয়ে উঠেছে র্যাফটিং। পাহাড়ি নদীপথে চারপাশের চোখজুড়োনো ছবির মতো দৃশ্য দেখতে দেখতে এগোনো। র্যাফটিং শুনলেই যে অ্যাডভেঞ্চারের কথা মনে হয়, তেমন গা ছমছমে ব্যাপার এখানে নেই। গাইডরা পাখিপড়া করে বুঝিয়ে দেবেন কখন কী করতে হবে। শুধু সেটুকু মেনে চললেই হল। খরচ পিক সিজনে মাথাপিছু দু’হাজার টাকা। নদীপথে ১৪ কিলোমিটার যাওয়ার পরে স্থানীয় একটি হোটেলে পোশাক বদলের ব্যবস্থা থাকে। সকাল-সকাল পুনাখা পৌঁছে র্যাফটিং সেরে চলে যেতে পারেন জং-এ। ঘুরে দেখতে অনেকটা সময় লাগবে। দুপুরে ফার্টিলিটি টেম্পল ঘুরে চলে যান আশপাশের গ্রামে। ফিরতে মন সায় দেবে না। অনেকেই থিম্ফু আর পারো-তে কয়েকটা দিন কাটানোর ফাঁকে পুনাখা ঘুরে যান মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। হলফ করে বলতে পারি, একদম ভুল সিদ্ধান্ত। ভুটান সফরে পুনাখায় রাত্রিবাস ‘মাস্ট’!
ভুটানে যেখানেই গিয়েছি সেখানেই দেখেছি বেশির ভাগ লোকজনের পোশাকে আটকানো ব্যাজে ঝলমল করছে রাজা-রানির ছবি। এ ভাবে ছবি আটকে ঘোরা বাধ্যতামূলক নাকি? স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নটা মনে এসেছিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কোনও বাধ্যবাধকতা নয়, আমজনতা ভালবেসে তাঁদের রাজপ্রতিনিধির ছবি নিজের শরীরে আটকে রাখেন।
রাজতন্ত্রের ধাঁচটা সময়ের সঙ্গে বদলে গেলেও রাজ আনুগত্য কমেনি ও দেশে!

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে পারো সরাসরি বিমান যায়। এ ছাড়া ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে
সেখান থেকে বাসে ফুন্টসোলিং যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে সরাসরি ফুন্টসোলিং যাওয়ার বাসও রয়েছে।
কখন যাবেন
যে কোনও সময়। তবে মার্চ থেকে মে এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর সবচেয়ে ভাল।
কোথায় থাকবেন
পারো এবং থিম্ফুতে প্রচুর হোটেল। তুলনায় পুনাখায় কম। আগে বুকিং করে নেওয়া ভাল।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.