সদ্য সন্তান হয়েছে। তাকে স্তন্যপান করাতে মায়েরও কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু সন্তানের পেট ভরানোর জন্য নাকি মায়ের বুকে যথেষ্ট দুধ হচ্ছেই না। অগত্যা কৌটোর দুধই ভরসা। সদ্যোজাতকে কৌটোর দুধ খাওয়ানোর সপক্ষে বেশির ভাগ সময়েই এমন যুক্তি শোনা যায়। অনেক সময়ে মায়েরাও চিকিৎসকের কাছে দাবি করেন, এত কম বুকের দুধ হচ্ছে যে, তাতে বাচ্চার পেট ভরছে না। তাই বাধ্য হয়েই বিকল্প পদ্ধতির আশ্রয় নিচ্ছেন তাঁরা। যদিও স্তন্যপানের পরিবর্তে কৌটোর দুধ খাওয়ানোর এই যুক্তি বহু ক্ষেত্রেই অবান্তর বলে দাবি চিকিৎসকদের। তাঁদের মতে, এই ‘মিথ’ই জন্মের পরে প্রথম ছ’মাস শিশুর ‘এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং’-এর পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ১ থেকে ৭ অগস্ট বিশ্ব স্তন্যপান সচেতনতা সপ্তাহে এই ‘মিথ’ দূর করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তাঁরা।
ব্রিটিশ জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর যত শিশু অপুষ্টিতে ভুগে মারা যায়, তার মধ্যে অন্তত ১৩ শতাংশকে বাঁচানো সম্ভব মায়ের দুধ খাইয়ে। কিন্তু এ নিয়ে তেমন সচেতনতা তৈরি হয়নি। সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, সদ্যোজাতকে মায়ের দুধ খাওয়ানোয় দেশের মধ্যে অনেক পিছিয়ে রয়েছে কলকাতা তথা গোটা পশ্চিমবঙ্গ। পরিবর্তে হু হু করে বাড়ছে টিনবন্দি দুধের চাহিদা।
এক বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, এ রাজ্যে জন্মের পরে প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে কোলোস্ট্রাম (জন্মের পরেই মায়ের শরীর থেকে যে হলুদ রঙের দুধ নিঃসৃত হয়) খাওয়ান ১৭.৮০% মা। জাতীয় স্তরে এই হার ২৮.৩০ শতাংশ। জন্মের পরে ছ’মাস পর্যন্ত শিশুর একমাত্র খাদ্য হিসেবে শুধু মায়ের দুধই খাওয়ান (এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং) এ রাজ্যের ২৭.৭০% মা। জাতীয় স্তরে এই হার ৩৯.৭০%। ওই রিপোর্ট পৌঁছে গিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র কাছেও।
শিশু চিকিৎসক প্রবাল নিয়োগী জানান, বহু মায়েরই ধারণা, বাচ্চার পেট ভরে না বলেই বাচ্চা কাঁদে। এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুল ধারণা। তিনি বলেন, “নজর রাখতে হবে ২৪ ঘণ্টায় শিশুটির পাঁচ-ছ’বার প্রস্রাব হচ্ছে কি না এবং ওজন ঠিক মতো বাড়ছে কি না। জন্মের পরে প্রথম কয়েক দিন ওজন কিছুটা কমে। তার পরে সপ্তাহে গড়ে ২০০ গ্রাম মতো ওজন বাড়ে। এই দু’টি ঠিক থাকলে বুঝতে হবে মায়ের দুধে বাচ্চার পেট ভরার ক্ষেত্রে সমস্যা নেই।”
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অল্প কিছু ক্ষেত্রে বুকের দুধ তৈরিতে সমস্যা তৈরি হয়। সেগুলি কী? তাঁরা জানান, মায়ের মানসিক সমস্যা থাকলে, অনেক ক্ষেত্রে দুধ হয় না। সন্তানের জন্মের পরে অনেকেরই এক ধরনের অবসাদ (পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন) তৈরি হয়। তখন দুধ কম হতে পারে। বিশেষ কিছু শারীরিক সমস্যায় দুধের পরিমাণ কম হতে পারে। তবে এগুলির সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগ সময়ে খাওয়ানোর প্রক্রিয়াতেই গলদ থাকে। তাই দুধ কম বেরোয়।
বিদেশে ‘ল্যাকটেশন কাউন্সেলার’ নামে একটি পদ রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে এমনকী ব্যক্তিগত ভাবেও এঁরা চেম্বার খুলে বসেন। কী ভাবে শিশুকে স্তন্যপান করানো উচিত, তা মা-কে বিশদে বোঝানোই তাঁদের কাজ। এ দেশে এখনও তেমন কোনও পেশাদার গোষ্ঠী তৈরি হয়নি। ডাক্তাররাই সন্তানের জন্মের পরে মাকে কিছুটা বুঝিয়ে দেন। ব্যস, ওই পর্যন্তই।
শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষের মতে, বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে মা ও সন্তানকে আলাদা রাখার ব্যবস্থাও বুকের দুধ কম হওয়ার জন্য দায়ী হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, “শিশুকে নার্সারিতে রাখার ব্যবস্থা একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। মা যদি সন্তানকে চোখের সামনে না দেখেন, তা হলে তাঁর দুধ কম নিঃসরণ হতে বাধ্য। বাচ্চার চেহারা, তার কান্না মায়ের দুধের ক্ষেত্রে ‘স্টিমুলেশন’-এর কাজ করে।”
শিশু চিকিৎসক সুব্রত চক্রবর্তী জানান, এক জন মায়ের যে দুধ হয় তাতে দু’টি শিশুরও পেট ভরতে পারে। তাঁর বক্তব্য, স্তন্যপান নিয়ে বাড়িতে এমন কোনও বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই, যাতে মায়ের দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে যায়। তিনি বলেন, “স্তন্যপান একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। তার জন্য মা-র স্বাভাবিক জীবনযাপনে যেন বাধা না দেওয়া হয়। মায়ের যা ইচ্ছা তিনি তা-ই খাবেন। দুধ বেশি হওয়ানোর জন্য অনেক সময়ে জোর করে দুধ-সাবু খাওয়ানো হয়। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।” ‘ব্রেস্ট ফিডিং প্রোমোশন নেটওয়াকর্’-এর রাজ্য শাখার আহ্বায়ক, চিকিৎসক পার্বতী সেনগুপ্ত অবশ্য স্তন্যপান নিয়ে সচেতনতা না বাড়ার পিছনে চিকিৎসকদেরও দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, “ইনফ্যান্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট অ্যাক্ট অনুযায়ী কৌটোর দুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার থেকে চিকিৎসকদের যে কোনও সুযোগ-সুবিধা নেওয়াই বেআইনি। কিন্তু ক’জন সেটা মানেন? অনেক সময়েই দেখা যায়, চিকিৎসকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মূল স্পনসরও ওই সব দুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা। এটা নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই। তাই মায়েরা কৌটোর দুধ খাওয়াতে চাইছেন, ডাক্তাররাও দিব্যি সেটাই প্রেসক্রাইব করছেন।” |